যুদ্ধাপরাধীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সাম্যবাদী দল। দলটির পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে ন্যস্তকরণ, ইভিএম চালু ও যুদ্ধাপরাধীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়াসহ মোট ৯টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)।

দলটি জানায়, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনগণের নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যত্যয় ঘটেছে। এ দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টিও জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলে মনে করে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক এ দলটি।

মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া তার লিখিত বক্তব্যে এ অভিযোগ করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ যাতে তাদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নির্বাচন কমিশনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের অনুরোধ করেন।

দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সংলাপে অংশ নেয়। সংলাপে একটি অর্থবহ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের যে কোনো উদ্যোগকে দলটি সহযোগিতা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। দলটির প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রয়েছে,

১) সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন

ক) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধানের আলোকে বর্তমান সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সরকার দৈনন্দিন কার্যাবলী ছাড়া নীতিগত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না।

খ) অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ থাকবে।

গ) নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নির্বাচন পূর্বে ও পরে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্বাচন কমিশনের অধীন থাকবে। এ সময়কালে তাদের করা কোনো অপরাধ ও কর্তব্যে অবহেলার জন্য নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে এবং সরকার তা বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে।

২) এনআইডি কার্ড সংশোধন 

এনআইডি কার্ডের ভুল সংশোধন করতে গিয়ে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হয়রানির সম্মুখীন হন, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত সম্ভব কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সংশোধনকারীদের হয়রানি থেকে রেহাই দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং হয়রানিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৩) ভোটার তালিকা :

ক) ভোটার তালিকা প্রকাশের পূর্বে তা সংশোধনের জন্য আইন অনুযায়ী ভোটার তালিকা প্রকাশ্য স্থানে টাঙিয়ে দেওয়ার বিধান রয়েছে। তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

খ) যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত কেউ ভোটার হতে পারবে না; হয়ে থাকলে ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত ব্যক্তি, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

গ) প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ ও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঘ) পার্বত্য শান্তি চুক্তি অনুযায়ী প্রকৃত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। 

৪) নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করা

ক) প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে যারা যেভাবেই ব্যয় করুক, তা প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় হিসাবে গণ্য হবে এবং তা কোনো ক্রমে নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন করবে না। প্রতি নির্বাচনী এলাকায় একজন নির্বাচনী কর্মকর্তা এ ব্যয় মনিটর করবেন এবং নির্বাচন কমিশনকে নিয়মিত রিপোর্ট প্রদান করবেন। এই রিপোর্টের সঙ্গে প্রার্থীর দেওয়া নির্বাচনী ব্যয়ের বিবরণ মিলিয়ে দেখা হবে।

খ) প্রার্থীর নির্বাচনী আয় ব্যয়ের বিবরণ সর্বসাধারণকে জ্ঞাত করতে উন্মুক্ত দলিল হিসাবে রাখতে হবে এবং প্রচার মাধ্যমকে তা সরবরাহ করতে হবে। যেকোনো ভোটার এ ব্যাপারে তাদের আপত্তি জানাতে পারবে।

গ) নির্বাচনী কাজে আয় ব্যয়ের হিসাব নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে এবং তা করতে না পারলে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ বন্ধ রাখতে হবে। ওই বিবরণীর যথার্থতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঘ) ভবিষ্যতে প্রার্থীদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নির্বাচনী ব্যয় বহনের ব্যবস্থা গ্রহণে পদক্ষেপ গ্রহণ নিতে হবে।

৫) নির্বাচনকে সন্ত্রাস, পেশি শক্তির প্রভাব ও দুর্বৃত্তমুক্ত করতে হবে

ক) নির্বাচনে সকল প্রকার বল প্রয়োগ অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা এবং বল প্রয়োগের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তিবিধান করতে হবে।

খ) ফৌজদারি দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত এবং দুর্নীতির দায়ে যেকোনো সময়ের জন্য সাজাপ্রাপ্তদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না।

৬) নির্বাচনে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকদের প্রভাব বন্ধ রাখতে হবে

ক) নির্বাচনে ধর্মের সর্বপ্রকার ব্যবহার সাম্প্রদায়িক প্রচার প্রচারণা ও ভোট চাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করতে হবে।

খ) ধর্মীয় উপাসনালয়, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, মঠ, ওয়াজ ও ধর্ম সভায় প্রত্যক্ষও পরোক্ষ কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার পোস্টার, হ্যান্ডবিল বিলি নিষিদ্ধ করতে হবে।

গ) ভোটের দিন সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলোতে নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

৭) নির্বাচনে সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা

ক) পোস্টার, লিফলেট, বৈদ্যুতিক, ডিজিটাল, বিজ্ঞাপন, মাইক, নির্বাচন ব্যানার, ফেস্টুন, দেয়াল লিখন গেট নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে যেসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আছে তা ব্যতিক্রমহীনভাবে পালন করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন কর্মকর্তা এ বিষয়ে নিশ্চিত করবেন। এক্ষেত্রে কোনো আইন ও বিধি ভঙ্গ হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অবিহিত করবেন।

খ) নির্বাচন কমিশন প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় সভার আয়োজন করবে।

গ) নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন থেকে সকল দলের কেন্দ্রীয় সমাবেশ, মহাসমাবেশ, র‌্যালি, জনসভার ব্যয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ঘ) নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রচলিত আইন অনুযায়ী নির্বাচনী অফিস ব্যতিরেকে কোনো নির্বাচনী ক্লাব, ক্যাম্প নির্বাচনী প্রচার কেন্দ্র হিসাবে কোনো কাঠামো করা যাবে না।

ঙ) রেডিও টিভির সময় সমভাবে বণ্টন করা এবং তার ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। 

৮)  ইভিএম চালু 

নির্বাচন ব্যবস্থাকে আধুনিক রূপ প্রদানের জন্য ইভিএম পদ্ধতি চালু সময়ের জরুরি দাবি বলে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএম) যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে।

৯) সংসদে প্রতিনিধিত্বের ধরন

এদেশে এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রয়েছে তা নির্বাচনে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের সহায়ক। তাছাড়া এ ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না ছোট অথবা সম্ভাবনাপূর্ণ দল সংসদ প্রতিনিধিত্ব পায় না, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের বদলে আনুপাতিক প্রতিনিধিদের পদ্ধতি চালু আছে। এই অবস্থা ভোট প্রাপ্তির হারের ওপর অধিক সংখ্যা নির্ধারিত হয়। নির্বাচন, সংসদ ও গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) এসব বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে।

এসআর/এসকেডি