বাংলাদেশ গর্ব করার মতো অর্থনৈতিক উন্নতি করছে। ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ এখন জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু ২০২৯ সালের পর ইউরোপের বাজারে এ সুবিধা পেতে হলে জিএসপি প্লাসের জন্য নতুন করে আবেদন করতে হবে। কিন্তু শ্রম খাত ও মানবাধিকার পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড উন্নীত না হলে জিএসপি প্লাস পাওয়া যাবে না। কাজেই এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উন্নতি করতে হবে।

মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সঙ্গে ডিকাব টক আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন
ইইউ সংসদীয় কমিটির সদস্য হেইডি হাওতালা।

হেইডি হাওতালা বলেন, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের সাথে ইইউর সম্পর্ক গভীর হয়েছে। যে কারণে ইইউ বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশি পণ্য ইইউর বাজারে রপ্তানিতে দ্বিগুণ হয়েছে। ইইউর চলমান জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে সাফল্য অর্জন করেছে তাতে দেশটি গর্ববোধ করতে পারে। উন্নতির পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। ২০২৬ সালের পরও পরবর্তী ৩ বছর অর্থাৎ আগামী ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেওয়া ইইউর চলমান জিএসপি (ইইউর ইবিএ স্কিমের আওতায় অস্ত্র ছাড়া সকল পণ্যে সুবিধা) সুবিধা বহাল থাকবে। কিন্তু এরপর এই সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে ইইউর কাছে নতুনভাবে জিএসপি প্লাসের জন্য আবেদন করতে হবে। ইইউর বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে।

হেইডি হাওতালা বলেন, আন্তর্জাতিকমানের বাণিজ্যিক পরিবেশ নিশ্চিত করা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল, যেখানে বাংলাদেশ নিয়ে অতীতে দুঃখজনক ঘটনা রয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনাকে আমরা এখনও স্মরণ করি। ওই ঘটনা খুবই হৃদয় বিদারক ছিল। ওই ঘটনার পরই বাংলাদেশে টেকসই বাণিজ্যিক পরিবেশ সৃষ্টিতে ইইউ আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়েছে। শ্রম খাত সংক্রান্ত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে এক বছর আগে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গিকার করেছে। আমরা সরকারের এই অঙ্গীকারকে স্বাগত জানাই। শ্রম খাত সংক্রান্ত রোডম্যাপ বাস্তবায়নকে আমরা অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকি।

এই রোডম্যাপ বাস্তবায়ন আগামীতে ইইউর বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সময়ে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলায় সুবিধা হবে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ পূর্ণাঙ্গভাবে রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করবে, যা বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেবে। এ মুহূর্তে আমরা বাংলাদেশের শ্রম খাতের সংশ্লিষ্ট আইন আন্তর্জাতিক মানে উন্নতি করতে বিলম্ব হওয়ায় উদ্বিগ্ন। সেই সাথে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া অঞ্চলের ((ইপিজেড) শ্রম আইন নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সকল ইপিজেড অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মানের শ্রম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করতে ইইউ যথাযথ সমর্থন দিতে প্রস্তুত আছে। 

হেইডি হাওতালা আরও বলেন, ইইউ শিশু শ্রম ইস্যুতে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে এবং গুরুত্ব দিয়ে থাকে। শিশুশ্রম ইস্যুতে বাংলাদেশ যে অঙ্গীকার করেছে তা আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই ইস্যুতে উন্নতি করতে ইইউ বাংলাদেশকে উৎসাহিত করছে। শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে হলে এই সংক্রান্ত পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকতে হবে। কেননা শ্রম অধিকার মানবাধিকারের মৌলিক নীতির গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। 

তিনি বলেন, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জিএসপি প্লাস পাওয়ার ক্ষেত্রে আরও একটি মৌলিক শর্ত। দেশে সিভিল সোসাইটির মত প্রকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকতে হবে। আমরা বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। মূল মানবাধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব ঘটনা জিএসপি প্লাস পাওয়ার ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একই সাথে আমরা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) নিয়েও উদ্বিগ্ন। ডিএসএ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে, বিশেষ করে সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে। তবে আমরা আইনমন্ত্রীর কাছ থেকে এই আইনের সংশোধনী সম্পর্কে আশ্বাস পেয়ে খুশি হয়েছি। 

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন সম্পর্কে হেইডি হাওতালা বলেন, এই সময়ের চলমান বৈশ্বিক উত্তেজনার পেছনে কারণ এবং পরিণতি সম্পর্কে বুঝতে হবে। ইইউ স্পষ্টভাবে জনাতে চায় যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। কিন্তু রাশিয়া অন্যায়ভাবে ইউক্রেনে যে আগ্রাসন চালাচ্ছে এই নিষেধাজ্ঞা তার বিরুদ্ধে। যে কারণে বিশ্ববাসীকে এখন অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। 

ইইউ সংসদীয় কমিটির সদস্য মেক্সিমিলান ক্রা বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতির মডেল ফলো করায় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে, যা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ তার অর্থনীতির উন্নতিতে এখন ইইউ থেকে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু সামনে এই সুবিধা থাকবে না। তখন জিএসপি প্লাসের জন্য আবেদন করতে হবে। 

মেক্সিমিলান ক্রা বলেন, বাংলাদেশে রাশিয়া পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে কাজ করছে। বাংলাদেশ কিন্তু নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই। বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে এই মুহূর্তে জ্বালানি কিনবে কিনা তা বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই বিষয়ে আমরা বাংলাদেশকে পরামর্শ দিতে পারি না।

ডিকাব সভাপতি রেজাউল করিম লোটাসের সভাপতিত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত ডিকাব টকে ইইউ আইএনটিএ প্রতিনিধিদলের পক্ষে ইইউ সংসদীয় কমিটির সদস্য হেইডি হাওতালা এবং মেক্সিমিলান ক্রা অংশ নেন। এ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটলি উপস্থিত ছিলেন।

এইউএ/এসকেডি