রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিং আছে। এর মধ্যে ২৩টিরই নেই অনুমোদন। ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে অন্যতম মগবাজার। এ ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন পথচারীরা। যদিও রেলওয়ে আইন অনুযায়ী ট্রেন আসার সময় কিংবা চলাচলের মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট রেল লাইনের দুই পাশেই ১০ ফুট পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি থাকে।

সোমবার (১ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মগবাজার লেভেল ক্রসিংয়ে দেখা যায়, রেলওয়ে আইনের পরিষ্কার লঙ্ঘন করে ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে রেল লাইনের উপরেই ইউটার্ন করছে ‍যানবাহন, ক্রসিং ব্যারিয়ার উঠিয়ে রেল লাইন পার হচ্ছে রিকশা, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার।

সরেজমিনে দেখা যায়, মগবাজার লেভেল ক্রসিংয়ে ইউটার্ন করছে বিভিন্ন যানবাহন। এক ঘণ্টায় ৩৭টি রিকশা, ১১টি প্রাইভেটকার, ২১টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, দুটি বাস, অসংখ্য মোটরসাইকেল অবৈধভাবে এ রেললাইনের উপর দিয়ে ইউটার্ন করে বিকল্প সড়কে গেছে।

পথচারী ও বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীরা বলছেন, রেল লাইনের উপর দিয়ে চলাচল, পারাপারে সচেতনতার বিকল্প নেই। অবৈধ ক্রসিং বন্ধ করা এবং যাত্রী-পথচারীদের নিরাপত্তায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা গেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।

সরেজমিনে দেখা যায়, মগবাজার লেভেল ক্রসিংয়ে ইউটার্ন করছে বিভিন্ন যানবাহন। এক ঘণ্টায় ৩৭টি রিকশা, ১১টি প্রাইভেটকার, ২১টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, দুটি বাস, অসংখ্য মোটরসাইকেল অবৈধভাবে এ রেললাইনের উপর দিয়ে ইউটার্ন করে বিকল্প সড়কে গেছে।

রাজধানী ও এর আশপাশে ৫৮টি ক্রসিংয়ের মধ্যে বৈধ একটি লেভেল ক্রসিং হচ্ছে মগবাজার। রেলের হিসেবে এটি রেল নিয়ন্ত্রণাধীন ইঞ্জিনিয়ারিং-১৬ নং মগবাজার রেলক্রসিং গেট। এর পূর্বে ই-১৫ নং মগবাজার বাজার গেট। পশ্চিমে ই-১৬/এ এফডিসি রেলগেট। তারপরই তেজগাঁও ট্রাফিক (টি)-১৭ নং রেলগেট। এই চারটি রেলগেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ পারাপার হয় ইঞ্জিনিয়ারিং-১৬ নং মগবাজার রেলক্রসিং গেট ব্যবহার করে।

আরও পড়ুন : রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত?

সেখানে কথা হয়, লাইনম্যান আলী আকবর মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে স্থায়ীভাবে রেলের অধীনে লাইনম্যান হিসেবে যোগদান করি। গত দেড় বছর ধরে মগবাজার রেলগেটে ডিউটি করছি।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার লগে একটু খাড়ান। দেখেন মানুষ কত বেপরোয়া, ব্যস্ত। সময়ের মূল্য দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রেললাইনের উপরে যানবাহন ইউটার্ন করছেন। ক্রসিং ব্যারিয়ার ফেলার পরও ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে। 

তিনি বলেন, আমরা এই সিগনালে মোট ১২ জন চারটি ব্যারিয়ার দেখভাল করি। প্রতি শিফটে ৪ জন করে আট ঘণ্টা করে ১২ জন ডিউটি করি। 

আরও পড়ুন : রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?

ফজলুর রহমান নামে আরেক লাইনম্যান বলেন, রেললাইনের উপরে ইউটার্নের নিয়ম নেই, সেটা এখানে নিয়মিত ঘটছে। কেউ ক্ষমতার জোরে, কেউ বা ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যাচ্ছে। ব্যারিয়ার ফেলার পরও অনেকে ওভারটেক করেন, ব্যারিয়ারের নিচ দিয়ে, এমনকি কখনো উপর দিয়ে পার হয়ে যান। আমরা অনুরোধ করলে কেউ শোনেন, কেউ শোনেন না, কেউ রক্তচক্ষু দেখিয়ে চলে যান। ট্রেন আসছে দেখেও অনেকে তড়িঘড়ি করে পার হন, কেউ পার হওয়ার চেষ্টা করেন। এসবই দুর্ঘটনা ডেকে আনে।

আরিফ হোসেন রাজি নামে এক পথচারী বলেন, অবশ্যই সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। রেলগেটে গেটম্যান বা লাইনম্যানের চেয়ে বেশি দায় পথচারী ও যানবাহন চালকদের। তড়িঘড়ি না করে যদি আমরা ধৈর্য ধরে রেললাইন পারাপার হই তাহলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটবে না।

চট্টগ্রামে আস্ত একটা মাইক্রোবাস ট্রেনের নিচে আটকে গেলো। সেখানে না হয় গেটম্যান ছিল না। কিন্তু যেখানে গেটম্যান বা লাইনম্যান আছে, সেখানে কি আমরা তাদের সিগন্যাল মানি?

এমন প্রশ্ন তুলে বৃদ্ধ পথচারী মো. আব্দুল আজিজ বলেন, জনসাধারণের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সবারই দায়িত্বশীল আচরণ করা দরকার। শুধু শুধু গেটম্যানদের দায় দিয়ে লাভ নেই। তবে যেসব স্থানে দুর্ঘটনা বেশি সেখানে কিন্তু চলাচলের জন্য ছোট ছোট ফ্লাইওভার করা যেতে পারে। 

আতিকুর রহমান রুহি নামে এক পথচারী বলেন, দুর্ঘটনার পর অনেক কথা শুনি। অনেক কিছু সংস্কারের প্রশ্ন আসে। কিন্তু আমার মনে হয় গেটম্যানরা ঠিকই দায়িত্ব পালন করেন। আমরাই সচেতন নই। লাইন ক্রসিংয়ে ব্যারিয়ার ফেলার পরও অটোরিকশা, মোটরসাইকেল চলাচল করে। দুর্ঘটনার পর হয়তো আমাদের টনক নড়ে। 

আরও পড়ুন : পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি

ঢাকা রেল পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেলওয়ে আইনে রেললাইন তথা লাইনের দু’পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুট এলাকায় সবসময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কেউ এ এলাকায় পা রাখলেই অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। কিন্তু এই কঠোর নিষেধাজ্ঞা অনেকেই মানেন না, মানতে চান না। মানুষের পারাপারের জন্য প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিং এলাকায় নিরাপদ পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা উচিত। তাহলে মানুষ বাধ্য হয়েই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করবে। দুর্ঘটনাও ঘটবে না। 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব ও রেলওয়ের অংশীজন মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাহারাদার, গেটম্যান থাকার পরও মিরসরাইয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যে এক হাজার ৩২১টি ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক ও পাহারাদার নেই, সেখানে কী ঘটছে? আমাদের এসব খেয়াল করা উচিত। 

তিনি বলেন, গেটম্যান যদি নাও থাকে দায় তো নিজের উপর বর্তায়। আগে নিজের জীবনের মূল্য দিতে জানতে হবে। পথচারী যানবাহন চালকদের সতর্ক হতে হবে। যত্রতত্র পারাপার থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি যেসব ক্রসিং দুর্ঘটনাপ্রবণ সেখানে উড়ালপথ করা যেতে পারে।

জেইউ/জেডএস