রাজধানীর প্রগতি সরণির ব্যস্ততম সড়কের মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ের চারটি ক্রসিং প্রতিবন্ধক (ব্যারিয়ার) বা গেটই অনেকটা অকেজো। এর মধ্যে একটি ব্যারিয়ার পুরোপুরি নষ্ট। আর বাকি তিনটি ব্যারিয়ারের অর্ধেক অংশই নেই। ফলে ট্রেন আসার সিগনাল দেওয়ার পর গেট আটকে রাখা হলেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও মোটরসাইকেলের চলাচল রোধ করা যায় না।

সরেজমিনে দেখা যায়, ট্রেন আসা-যাওয়ার দুই থেকে তিন সেকেন্ড আগেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছে। লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেটম্যান হাত ধরে টেনেও মানুষের চলাচল রোধ করতে পারছেন না। বাধা দিতে গেলে ধাক্কা দিয়ে হলেও ক্রসিং পার হচ্ছে মানুষ। ফলে এই লেভেল ক্রসিংগুলো অনেকটা মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব ও রেলওয়ের অংশীজন মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গেটম্যান থাকুক আর না থাকুক আমাদের জীবনের নিরাপত্তা আমাদের কাছেই। এ ক্ষেত্রে লেভেল ক্রসিং পারাপারে পথচারী ও যানবাহন চালকদের সতর্ক হতে হবে। যত্রতত্র পারাপার থেকে বিরত থাকতে হবে।

আরও পড়ুন : রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত?

সোমবার (১ আগস্ট) দুপুর ১টা থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময়ে দেখা গেছে, মালিবাগ লেভেল ক্রসিং দিয়ে পাঁচ-দশ মিনিট পর পর কমলাপুর রেল স্টেশনে আসা-যাওয়া করছে ট্রেন। এই ক্রসিংয়ে চারটি ব্যারিয়ারের মধ্যে মালিবাগের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ব্যারিয়ারটি (মালিবাগ থেকে মৌচাক যাওয়ার রাস্তায় রং ব্যারিয়ার) বন্ধ করা হচ্ছে না। প্রায় একই অবস্থা উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত রং ব্যারিয়ারটিরও। এটিও কখনও কখনও বন্ধ করা হচ্ছে, আবার কখনও কখনও খোলাই থাকছে।

তবে মেইন ব্যারিয়ার দিয়ে মৌচাক থেকে রামপুরা চলাচলের সিগনালটি বন্ধ করা হচ্ছে। একইভাবে রামপুরা থেকে মৌচাক আসার মেইন ব্যারিয়ার বন্ধ করছেন গেটম্যানরা। এছাড়াও যখনই ট্রেন আসছে, তখনই ক্রসিং এলাকা থেকে সরে যাওয়ার জন্য বাঁশি বাজিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন গেটম্যানরা। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন আসা-যাওয়ার এক কিংবা দুই সেকেন্ড আগেও রাস্তা অতিক্রম করছে মানুষ। গেটম্যানরা রিকশাচালক, বাইসাইকেল কিংবা মোটরসাইকেল চালকদের কিছু বললে তারা উল্টো খারাপ আচরণ করছে। কখনও কখনও গেটম্যানদের ওপর চড়াও হচ্ছে।

চারটি ব্যারিয়ারের মধ্যে উত্তর-পশ্চিমের রং ব্যারিয়ারের অর্ধেক অংশ নেই। এ কারণে ব্যারিয়ার ফেলা হলেও মাইক্রোবাস, রিকশা ও মোটরসাইকেল সহজেই ক্রসিং পার হচ্ছে। একই অবস্থা প্রধান দুটি ব্যারিয়ারেরও। এই দুটি ব্যারিয়ার নামানোর পরও অনেক জায়গা থেকে যায়। সে জায়গা দিয়ে রিকশা-মোটরসাইকেল আসা-যাওয়া করছে।

আরও পড়ুন: ট্রেন আসছে দেখেও লাইনের ওপর ইউটার্ন, ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার

শুধু তাই নয়, এ সময় দেখা গেল রেল লাইনের মধ্যে রিকশা রেখে আয়েশ করে পাশের দোকানে চা পান করছেন রিকশাচালক। লেভেল ক্রসিংয়ের চারটি ব্যারিয়ারের মধ্যে তিনটির পাশেই রয়েছে কলা-পেয়ারা ও চায়ের দোকান। এই দোকানগুলোতে ক্রেতারা ভিড় করছে। এ কারণে ক্রসিং পার হওয়া যানবাহন ও যাত্রীদের কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

রেল লাইনের ওপর রিকশা রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে রিকশাচালক আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেন আসেনি, রাস্তাও ফাঁকা ছিল তাই রেখেছি। তারপর হাসতে হাসতে তিনি বলেন, এখন চলে যাচ্ছি।

কমলাপুর থেকে আসা একটি ট্রেন মালিবাগ লেভেল ক্রসিং অতিক্রম করার ৩ সেকেন্ড আগে উল্টো পথে বাইসাইকেলে করে ক্রসিং পার হন মিজান নামের একজন। এসময় গেটম্যানরা জোরে জোরে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু গেটম্যানের নির্দেশ অমান্য করে ক্রসিং পার হন তিনি। মিজানের কাছে জানতে চাইলে তিনি উল্টো ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, আপনার কি? আমার জরুরি কাজ আছে তাই চলে আসছি।

আট বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসা গেটম্যান মোবারক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শিফট অনুযায়ী ডিউটি করি। দুই মাস ধরে একটি ব্যারিয়ার নষ্ট। অফিসকে জানিয়েছি, কিন্তু অফিস কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তিনি বলেন, ব্যারিয়ার ফেলার পরও হোন্ডা ও রিকশাচালকরা কথা শুনে না। তারা হ্যাডাম (শক্তি) দেখাইয়া চলে যায়। কিছু বললে মারতে আসে। বেশি সমস্যা করে হোন্ডাওয়ালা।

মোবারক বলেন, কয়েক দিন আগে এক রিকশাচালক ব্যারিয়ার উঠিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি তাকে শাসন করায় রিকশাচালক আমাকে বলল, আমি মরলে তোর কি?

আরও পড়ুন: সিগন্যাল-ব্যারিয়ার দিয়েও আটকানো যায় না

গেটম্যান সোহানুল আলম সুজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে আইন আছে কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, ট্রেন আসার আগে ৪০ গজের মধ্যে কেউ আসতে পারবে না। ১৪৪ ধারা জারির মতো থাকবে। কিন্তু কেউ সেই আইন মানে না।

তিনি বলেন, ট্রেন আসার খবর পেয়ে যখন গেট ফেলে সিগনাল দেই তখন মানুষ এই সিগনাল মানতে চায় না। বাঁশ ফেলার সময় হঠাৎ করে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান ঢুকে যায়। তারা স্বার্থের দোহাই দেয় আবার পাওয়ার দেখিয়ে গেট খুলে চলে যায়। তখন অনেকে মনে করে আমরা গেটম্যানরা অবহেলা করি।

এই গেটম্যান বলেন, ট্রেন কাছাকাছি চলে আসার পরও চিপা দিয়ে মোটরসাইকেল ঢুকে যায়। আবার গেটের নিচে মাথা দিয়ে মানুষ পার হতে চায়। তখন আমরা বাঁশি বাজাই। তারপরও কেউ না মানলে টান দিয়ে ধরে রাখি। তাদের বাঁচাতে ধরলে পরে ঝগড়া লেগে যায়।

সোহানুল আলম বলেন, এখানে চারটি ব্যারিয়ারই নষ্ট। এগুলো পরিবর্তন করা দরকার। আমরা কোম্পানির ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি জানিয়েছি। দ্রুত নতুন ব্যারিয়ার চলে আসবে বলে স্যাররা আমাদের জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন : রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে পুলিশের এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাতে কিংবা সকালে ক্রসিং দিয়ে যানবাহন ও লোকজন চলাচল কম করে। কিন্তু দুপুর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এলাকা পুরো জ্যাম থাকে। শত সতর্ক করা হলেও মানুষ কথা শোনে না। ট্রেন কাছাকাছি চলে আসার পরও দৌড়ে ক্রসিং পার হয়।

ঢাকা রেল পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেলপথ আইনে ট্রেন লেভেল ক্রসিংয়ের সময় নির্ধারিত এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। এসময়ে রেলওয়ের দায়িত্বরত ব্যক্তি ছাড়া কেউ এ এলাকায় যেতে পারবে না। যদি কেউ যায় তবে তিনি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। কিন্তু এই কঠোর নিষেধাজ্ঞা অনেকেই মানেন না, মানতে চান না।

তিনি বলেন, লেভেল ক্রসিং এলাকায় মানুষের নিরাপদ পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা উচিত। তাহলে মানুষ বাধ্য হয়েই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করবে। দুর্ঘটনাও ঘটবে না।

এমআই/এসএসএইচ