মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে না পেরে এরই মধ্যে শহর ছেড়েছেন অনেক শ্রমজীবী মানুষ/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

এক দিকে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে জ্বালানি তেল, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস অবস্থা সাধারণ মানুষের। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও এর প্রভাব পড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে না পেরে এরই মধ্যে শহর ছেড়েছেন অনেক শ্রমজীবী মানুষ। আবার অনেকে পরিকল্পনা করছেন শহর ছাড়ার। কেউ পরিবারের সদস্যদের বাড়ি পাঠিয়ে সংসারের ব্যয়ে লাগাম টানার চেষ্টা করছেন।

তাদের ভাষ্য, ‘এখন দেশে মইরা বাঁইচা আছি। কি কইরা খামু, দিশকুল খুঁইজা পাই না। খরচ বাড়ছে ৩ থেকে ৫ হাজার টেকা। কিন্তু ইনকাম এক টেকাও বাড়ে নাই।’

শুক্রবার (১২ আগস্ট) রাজধানীর বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

বেশি উপার্জনের আশায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা পেশার মানুষ ভিড় জমান ঢাকায়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য, নিজে কষ্ট করে হলেও পরিবারের সদস্যদের ভালো রাখা। কিন্তু সময় পরিবর্তন হতে হতে এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে যে, শহরে এখন নিজেরাই ভালো থাকতে পারছেন না। শহরে আবাসন, খাওয়া, যাতায়াত থেকে শুরু করে এমন কোনো খাত নেই যেখানে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে না। ফলে শহর আর আগের মতো আয় হচ্ছে না শ্রমজীবী মানুষের। তাই শহর ছাড়ার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা।

রাজধানীর সদরঘাট-গাবতলী বেড়িবাঁধ সড়কে একটি ওয়েল্ডিং কারখানায় কাজ করেন মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন রাজু। এ পেশায় আছেন ১৭ থেকে ১৮ বছর। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকার রায়ের বাজার এলাকায় থাকেন। তবে এখন আর পরিবার নিয়ে থাকেন না। একাই থাকেন।

আরও পড়ুন : দেশের মানুষ বেহেশতে আছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী 

কারণ হিসেবে রাজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘ সময় ঢাকা শহরে ঝালাইয়ের কাজ করেছি, এখনও করছি। এখন আর আগের ঢাকা নেই। আগে দুই পয়সা ইনকাম করে নিজের জন্য রাখা যেত আবার বাড়িতেও পাঠানো যেত। কিন্তু এখন ঢাকার টাকা ঢাকায়ই রেখে যেত হয়। বাড়িতে আর সহজে পাঠানো যায় না।

তিনি বলেন, গত ৬ মাস আগেও ১২ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া আর সংসারের বাজার খরচ চালিয়েছি। বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে টাকাও পাঠিয়েছি। এখন আর হচ্ছে না। পরে গত মাসে বাসা ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী সন্তানকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি থাকছি মেসে। এখন বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছি। বহু বছর তো কাজ করলাম দেশে, কিন্তু টাকা ধরে রাখতে পারিনি। জিনিসপত্রের দাম এতো বেশি, কুলিয়ে উঠতে পারছি না।

আরেক ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি জুয়েল বলেন, বাবা-মা, স্ত্রী সন্তান নিয়ে মোট ৫ জন ঢাকায় থাকি। সবার খরচই আমাকে বহন করতে হয়। ২৪ হাজার টাকা বেতন পেয়েও এখন হাঁপিয়ে ওঠেছি। গত ২ মাস ধরে আমার স্বাভাবিক খরচ বেড়েছে ৫ হাজার টাকা। গত মাসে মালিক ২ হাজার টাকা বেতন বাড়িয়েছে। এখন যে দাম বেড়েছে, তাতে না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা।

তিনি বলেন, হিসেবে অনেক টাকাই ইনকাম করি। কিন্তু ঢাকায় আর টাকা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। যা ইনকাম করি, ঢাকা শহর সব কেড়ে নেয়। নিজে না খেয়ে থাকলেও তো পরিবারের অন্য সদস্যদের না খাইয়ে রাখতে পারি না।

রায়ের বাজার এলাকায় ঘুরে ঘুরে ভ্যানে আখের রস মাড়িয়ে বিক্রি করেন জাহাঙ্গীর। তার পরিবারেও ৫ জন সদস্য। বাধ্য হয়ে গত মাসে ধার করে নতুন আরেকটি ভ্যান কিনেছেন। সেটি এখন চালায় তার ১৫ বছরের ছেলে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবা আমরা গরিব মানুষ। দিন এনে দিন খাই। এমনিতে বাজার ৫০-৬০ টাকার নিচে কোন সবজি পাওয়া যায় না। তার ওপর সরকার আবার ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে। আখের রস মাড়াই করতে ভ্যানে যে মেশিনটি আছে, সেটি ডিজেলে চলে। বাড়ি থেকে মনে করে, আমি ঢাকা শহরে থাকি, অনেক টাকা কামাই করি। আসলে আমরা ‘মইরা বাঁইচা আছি’।

আরও পড়ুন : গাড়ি বেড়েছে, সড়ক কমেছে, জনবল বাড়েনি ট্রাফিক পুলিশের

শংকর এলাকায় রিকশা চালান আমিরুল। তার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের হিলিতে, ৭ সদস্যের পরিবার। সবার দায়িত্ব তার কাঁধে। এখানে থাকেন রিকশার গ্যারেজে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দিন ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা ইনকাম হয়। আগে বাড়িতে বাজার খরচ হিসেবে ৫ হাজার টাকা খরচ হত। এখন হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কারণ, দাম শুধু বাড়ছেই, কমছে না। বাজার খরচ বাড়ছে, গরু ছাগলের খাবারের দাম বাড়ছে। নাতির স্কুল খরচও দিতে হয়।

তিনি আরও বলেন, এই শহরে আমি টানা ৩ মাস রিকশা চালাই আর একমাস করে বাড়িতে থাকি। এভাবে ৭-৮ বছর ধরে রিকশা চালাই। আগে অনেক টাকা জামিয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতাম। এখন মাসের খরচ ছাড়া আর তেমন কিছু নিয়ে যেতে পারি না। শুধু ঢাকা না, গ্রামেও খরচ বেড়ে গেছে।

এমএইচএন/এসকেডি