প্রায় ১৫ বছর আগে ঢাকায় রিকশা চালানো শুরু করেন কামাল হোসেন কমল। একদিন তার রিকশাটি চুরি হয়ে যায়। এরপর চুরি যাওয়া রিকশার খোঁজ করতে গিয়ে সন্ধান পান চোর চক্রের। নিজেও জড়িয়ে যান রিকশা চুরিতে।

বুধবার (১৭ আগস্ট) ভোরে কমলসহ রিকশা চোর চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছে র‍্যাব। র‍্যাব জানায়, আসামিরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা চুরির পর সবুজবাগ ও মুগদা এলাকায় বিভিন্ন গ্যারেজে সেগুলো রাখত। পরে রং পরিবর্তন করে বাজারে বিক্রি করত।

চক্রের আটক বাকি সদস্যরা হলেন- মো. সাজু, মো. ফজলু ও শাহিন সরদার।

দুপুরে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এবিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ। 

তিনি বলেন, কমল এই চক্রের প্রধান। সে ১৫ বছর আগে কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করে। একদিন তার রিকশা চুরি হয়। চুরি যাওয়া রিকশা খুঁজতে গিয়ে অপরাধ জগতের সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর সে নিজেই রিকশা চুরিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। 

কমল ১২ বছর ধরে রিকশা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি করে আসছে। প্রথমে কমল একাই রিকশা চুরি করত। কৌশল হিসেবে নতুন রিকশায় উঠে রিকশা চালককে বিষাক্ত কোমল পানীয় খেতে দিয়ে অজ্ঞান করে রিকশা নিয়ে পালিয়ে যেত। আবার কখনও রিকশা চালক কোমল পানীয় খেতে রাজি না হলে তার নাকের কাছে চেতনানাশক ভেজানো রুমালের ঘ্রাণ দিয়ে অজ্ঞান করে রিকশা চুরি করত। কয়েক বছরের মধ্যে রিকশা চুরির জন্য একটি চক্র গড়ে তোলে কমল। 

যেভাবে রিকশা চুরি

র‍্যাব জানায়, চক্রটি রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াত। রিকশা চালাত সাজু। রাস্তায় নতুন রিকশা পেলে সেই রিকশার ওপর তারা নজরদারি করত। তারপর কমল রিকশার ড্রাইভারকে বলত সামনের রাস্তায় একটি বাসা থেকে আমার কিছু মাল তুলব। সেই মালগুলো কাছাকাছি আরেকটি বাসায় পৌঁছে দিলে সে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব দিত এবং রিকশা চালকের কাছ থেকে তার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করত। বেশি ভাড়া পাওয়ার লোভে সহজ সরল রিকশা চালক তার কথায় রাজি হয়ে যেত। তারপর তার সুবিধামতো একটি বাসার সামনে রিকশা থামিয়ে ড্রাইভারকে বলত আপনাকে বাসার ভেতরে ঢুকে মালামাল নিয়ে আসতে হবে। ড্রাইভার বাসার ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র চক্রের অপর সদস্য ফজলু গাড়ি নিয়ে সেই স্থান থেকে দ্রুত পালিয়ে যেত। 

তারপর কমল মালামালসহ রিকশা চালককে নিয়ে এলে রাস্তায় রিকশা না পেয়ে চালক কান্নাকাটি শুরু করত। তখন কমল রিকশা খোঁজার নাম করে তাদের চক্রের রিকশা নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেত। এরপর এসব চুরি যাওয়া রিকশা শাহীন, আকবর, মনির এবং বাবলুর গ্যারেজে নিয়ে লুকিয়ে রাখত। পরে রিকশার মালিককে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ দাবি করত। মুক্তিপণের টাকা বিকাশের মাধ্যমে আদায় করত। এরপর একটি অজ্ঞাতস্থানে রিকশা রেখে মালিককে সেটি নিয়ে যেতে বলত।

র‍্যাব জানায়, এই কৌশলে রিকশা চুরি করার পর সে তার সহযোগীসহ একাধিকবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়। তারপর সে তার চুরির কৌশল পরিবর্তন করে। সে ও তার সহযোগীরা বেশি ভাড়ায় একটি রিকশায় উঠে চালককে নির্জন স্থানে নিয়ে তাকে মারধর করে হাত-পা বেঁধে রাস্তায় ফেলে রেখে রিকশা নিয়ে পালিয়ে যেত। চুরির পর রিকশার রং পরিবর্তন করে খোলা বাজারে রিকশাটি বিক্রি করে দিত। কখনও রিকশার মোটর পার্টস খুলে আলাদা আলাদা বিক্রয় করত।

সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, কমল রিকশা চুরির মূল পরিকল্পনাকারী। তার নেতৃত্বে রাস্তায় নজরদারি করে টার্গেট নির্ধারণ করা হত। কমল টার্গেটের সঙ্গে কথা বলে রিকশার ভাড়া ও গন্তব্য নির্ধারণ করত। তার সহযোগী সাজু চোরাই রিকশা চালিয়ে নিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিত। তার অন্যতম সহযোগী ফজলুর সহায়তায় চোরাই করা ব্যাটারিচালিত রিকশার রং, সিটকভার পরিবর্তন করে বিভিন্ন লোকজনের কাছে বাজার দামের অর্ধেকে বিক্রি করে দিত। তারা রিকশা চুরির উপযুক্ত স্থান হিসেবে বাসাবো বাস স্ট্যান্ড এলাকা, মান্ডা এলাকাকে বেছে নিত। এভাবে চক্রটি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গত ৭ বছর ধরে পাঁচ শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা চুরি ও ছিনতাই করে গবিব ও নিরীহ রিকশা চালক ও মালিকদের সর্বস্বান্ত করে আসছে। এসব রিকশা তারা ৫ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করত।

এ সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন রংয়ের ব্যাটারিচালিত ২৩টি অটোরিকশা, ১৮টি অটোরিকশার চার্জার ব্যাটারি, ৪টি মোবাইল ফোন, ৪টি মাস্টার চাবি এবং নগদ ১৬০০ টাকা উদ্ধার করা হয়।

এআর/জেডএস