ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় একটি নার্সিং কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলেন- প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূলহোতা ফরিদা খাতুন (৫১), মোছা. মনোয়ারা খাতুন (৫২), মোছা. নার্গিস পারভীন (৪৭), মোছা. কোহিনুর বেগম (৬৫), মো. ইসমাইল হোসেন(৩৮) এবং আরিফুল ইসলাম (৩৭)।

র‌্যাব বলছে, গত ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের ১ম বর্ষ ফাইনাল বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্নপত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আদান-প্রদানের তথ্য পায় র‌্যাব। এরপর রোববার রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০ এর অভিযানে রাজধানীর মহাখালী, ধানমন্ডি ও আজিমপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাবের দাবি, একেকটি প্রশ্নপত্র বিক্রি করা হয় ১৫ হাজার টাকায়। গ্রেপ্তাররা সবাই বিভিন্ন স্বনামধন্য নার্সিং প্রতিষ্ঠানের ইন্সট্রাক্টর ও শিক্ষক।

সোমবার (২২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। 

আরও পড়ুন : শিক্ষক খুনি সমাজসেবী একজোট হয়ে প্রশ্নফাঁস

তিনি বলেন, গত ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের ১ম বর্ষ ফাইনাল বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষা শুরুর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নপত্র আদান-প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দল একটি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের মোবাইলে প্রশ্নপত্রের ছবি ও সাদা কাগজে হাতে লেখা প্রশ্নপত্রের ছবি উদ্ধার করে। অভিযোগ পাওয়ার পর র‌্যাব প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের এই ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞসাবাদে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৯৮টি নার্সিং কলেজের মধ্যে বর্তমানে ৩৮টি কলেজে পরীক্ষা চলমান। প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন প্রশ্ন প্রণয়নকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা দুই সেট আলাদা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে থাকেন। 

পরবর্তীতে এই প্রশ্নপত্রগুলোকে যাচাই-বাচাই করার জন্য একটি মডারেটর টিম নিয়োগ করা হয়। যাদের কাজ হচ্ছে প্রশ্নপত্রগুলো থেকে পরীক্ষার জন্য এক সেট পরিপূর্ণ প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেগুলো সিলগালার মাধ্যমে চিকিৎসা অনুষদের ডিনের কাছে জমা দেওয়া।

চিকিৎসা অনুষদের ডিন বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য ৪ সদস্যদের একটি  টিম নিয়োগ করে থাকেন; যারা নির্বাচিত প্রশ্নপত্রটি প্রিন্টিং এবং প্যাকেজিংয়ে নিযুক্ত থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করে আলাদা আলাদা প্যাকেটে কেন্দ্রের নাম লিখে সিলগালা করে দেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই প্রশ্নপত্রগুলো বিভিন্ন কেন্দ্রে বিতরণ করে থাকেন।

র‌্যাব বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূলহোতা ফরিদা খাতুন। তিনি রাজধানীর মহাখালীর কম্প্রেহেনসিভি নার্সিং অ্যান্ড প্যাথফিজিওলোজি বিষয়ের প্রশিক্ষক। প্রায় ১০ বছর যাবত এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং ও প্যাকেজিংয়ের দায়িত্বে থাকেন। চক্রের অপর সদস্য নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম তার অন্যতম সহযোগী। তারা  শিক্ষকতার আড়ালে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছেন।

গ্রেপ্তার ফরিদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় চিকিৎসা অনুষদের ডিন কর্তৃক নির্বাচিত ৪ সদস্যদের গোপনীয় টিমের একজন।  

আরও পড়ুন : গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে ছিল ভারতে, ফিরেই জড়ায় প্রশ্নফাঁস চক্রে

গত ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার হওয়া নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফরিদা খাতুনের কাছে চাইলে প্রিন্টিং ও প্যাকিংয়ের সময় সংগ্রহ করে রাখা প্রশ্নপত্র তিনি প্রদান করেন।

তাদের এই চক্রের আরেক সদস্য প্রশ্নপত্রটি ইসমাইলের মাধ্যমে কোহিনূর বেগমের হাতে দেয়। এসময় ইসমাঈল কিছু কপি নিজের কাছে রেখে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে তার ঘনিষ্ঠজনদের নিকট সরবরাহ করেন।

কোহিনূর বেগম ও আরিফ  অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নপত্রটি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেন।

গ্রেপ্তার ফরিদা, মনোয়ারা, নার্গিস বিগত প্রায় ১০ বছর যাবত একটি নার্সিং কলেজের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তারা ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি, মডারেটর ও ডিন কর্তৃক নির্বাচিত প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং এবং প্যাকিংয়ে নিযুক্ত গোপন টিমের সদস্য ছিলেন। 

গ্রেপ্তার কোহিনুর বেগম ২০০৮ সাল থেকে ঢাকার একটি সরকারি নার্সিং কলেজে নার্সিং প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন।

গ্রেপ্তার ইসমাঈল হোসেন রাজধানীর একটি নার্সিং কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত এবং গ্রেপ্তার আরিফ ঢাকার একটি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী।

তারা গত ২০ আগস্ট কোহিনূর বেগমের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করে।

গ্রেপ্তার আরিফ ২০১৭ সালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অপরাধে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন। 

আরও পড়ুন : প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বগুড়ার নারী ভাইস চেয়ারম্যান রূপা বরখাস্ত

খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, এই চক্রে আর কয়েকজনের নাম আমরা জেনেছি, তাদের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এই প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুরু থেকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছে।

ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেখিয়ে কি পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে জানতে চাইলে র‌্যাব মুখপাত্র প্রশ্ন প্রতি ১৫ হাজার টাকা করে নেওয়ার তথ্য মিলেছে।

জেইউ/এনএফ