অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ (বাঁয়ে) ও অধ্যাপক ড. সি আর আবরার/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় দেশটির আপত্তির বিষয়ে গত ২২ জুলাই রায় ঘোষণা করে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)। রায়টি ছিল মানবতার পক্ষে, অপরাধের বিরুদ্ধে। রায়ে মিয়ানমারের আপত্তি প্রত্যাখ্যান করা হয়, যা মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির পথ প্রশস্ত করে। এ রায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এতে মিয়ানমারের ফাঁদে পড়তে পারে বাংলাদেশ।

মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ (২৫ আগস্ট)। ৫ বছরেও রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত হয়নি। অর্থাৎ কবে রোহিঙ্গারা নিজেদের মাটিতে ফিরে যাবে বা আদৌ কোনোদিন তারা যেতে পারবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সহসা শুরু হচ্ছে না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। আর প্রত্যাবাসন প্রশ্নে তড়িঘড়িতেও তাদের আপত্তি আছে। তারা বলছেন, তড়িঘড়ি  করতে গিয়ে মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু জেনে-বুঝে, অন্য কয়েকটি দেশকে অংশীজন হিসেবে সঙ্গে রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যেতে হবে।

নাগরিক সুবিধার সব শর্ত পূরণ হলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চান মিয়ানমারে। তবে সেটা কতটুকু সম্ভব— জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘মিয়ানমার এ বছরই প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করবে। এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। মিয়ানমার চেষ্টা করবে প্রত্যাবাসন শুরু করে এটিকে ঝুলিয়ে ফেলতে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) থেকে দুই দুটি জাজমেন্ট এসেছে রোহিঙ্গাদের পক্ষে। চূড়ান্ত জাজমেন্টও রোহিঙ্গাদের পক্ষে আসবে, তা অনুমান করা যায়, বা ভিন্ন কিছু ঘটবে না রায়ে। এর মধ্যে আমেরিকার মতো বড় দেশ তিন-সাড়ে তিন বছর গবেষণার পর জানিয়েছে, মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়েছে। এটা কিন্তু আশার দিক।’

তিনি বলেন, ‘আইসিজে দ্বিতীয় জাজমেন্টে কিন্তু ইনডিপেন্ডেন্ট কমিশনের উদ্ধৃতি দিয়েছে। তারা আগেই বলেছে, গণহত্যা হয়েছে মিয়ানমারে। সে জায়গায় মিয়ানমার খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে যে, চূড়ান্ত রায়ে জেনোসাইড ও প্রত্যাবাসনের বিষয়টি থাকবে। কিন্তু মিয়ানমার চাইবে প্রত্যাবাসনে সংখ্যা কমাতে। কীভাবে সংখ্যা কমিয়ে প্রত্যাবাসন করা যায়, সে কূটকৌশল খুঁজবে। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে বোঝাতে চাইবে, তারা কিন্তু প্রত্যাবাসন শুরু করেছে। তড়িঘড়ি করে কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চাইবে। এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকা দরকার।’

আরও পড়ুন : যোগ-বিয়োগের কারসাজিতে কোটি কোটি টাকা লোপাট!

বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করে এ অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের ট্র্যাপে (ফাঁদ) পড়ে যেতে পারি। কারণ মিয়ানমার ৫ বা ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করবে যে, তারা জেনোসাইড চালায়নি। জেনোসাইড মানেই হচ্ছে ইনটেন্ট টু ডেস্ট্রয়। বলতে পারে, আমরা তো লোক নিয়েছি। আমরা তো ডেস্ট্রয় করতে চাইনি। আরও বলতে চাইবে যে, অন্যদের ঠিক মতো রেজিস্ট্রেশন হয়নি। তাদের নেওয়া সম্ভব নয়। পুরো প্রক্রিয়া না জেনে, না বুঝে যেন প্রত্যাবাসন শুরু না হয়, সেদিকটা অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রত্যাবাসন শুরু হলে অবশ্যই একাধিক দেশ যেন জড়িত থাকে— তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, মিয়ানমারের মতো দেশকে বিশ্বাস করার কোনো মানে নেই। তারা প্রত্যাবাসন করতে চাইছে, এটি নানাভাবে বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা বরাবরই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করবে। তালিকা একটু বাড়িয়ে প্রত্যাবাসনে রাজি হতে পারে। অনেক দেশের উপস্থিতি মিয়ানমারকে দুর্বল করে দেবে।’

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না কেন— বলে বলে সবাই অধৈর্য হচ্ছে। মিডিয়া, বিশ্লেষক, গবেষক, দেশি-বিদেশি স্টেকহোল্ডার বা কক্সবাজারবাসীও অধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে। সবাই মনে করছে এরা (রোহিঙ্গারা) মনে হয় কখনোই যাবে না। এতে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয়। সরকার চাপে পড়েছেও। আমি এত অধৈর্যের কিছু দেখছি না।’

আরও পড়ুন : পাসপোর্ট সেবা প্রশ্নবিদ্ধ, চোখ কেন এনআইডিতে?

২০১৭ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তিতে ‘তড়িঘড়ি’ করাটা বাংলাদেশকে দুর্বল করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অধৈর্যের কারণে তড়িঘড়ি করে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছিল, সেটা ঠিক হয়নি। তড়িঘড়ি করে করাটা আমাদের দুর্বল করেছে। ওরা জেনোসাইড করেছে, এটা তো স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। আমাদের আসলে সেরকম শক্তিশালী বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দরকার ছিল। যে দেশ জেনোসাইড করছে, তাদের মোরালিটি বা অথরিটির কী ধরনের বৈধতা থাকতে পারে?’

রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘ ও ইউএনএইচসিআরের চেষ্টায় সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘তাদের ম্যান্ডেট রিফিউজি দেখা। কিন্তু তাদের নানা এজেন্ডা থাকে। তাদের নানা জিও পলিসি, পলিটিক্স আছে। মানবিক দিক যতটা না, তারচেয়ে বেশি পলিটিক্সে জড়িয়ে আছে জাতিসংঘ ও ইউএনএইচসিআর। বছরের পর বছর তো তারা এ ইস্যুতে জড়িত। কী করেছে তারা? জাতিসংঘ ও ইউএনএইচসিআরের ওপর ভরসা করে লাভ নেই, বরং সমাধান করতে হলে বাংলাদেশ-মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে। কিন্তু তড়িঘড়ি নয়, পলিসি বুঝে, সবকিছু দেখে, জেনে-শুনে তারপর প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে। প্রত্যাবাসন শুরু করলে ১০, ২০ বা ৫০ হাজার নয়, সব রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের আওতায় আনতে হবে।’

এক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সমাধানের ক্ষেত্রে সবদিক তুলে আনতে হবে। আইসিজে যে রায় দিয়েছে সেটা তুলে আনতে হবে। মিয়ানমারের জেনোসাইডকে গুরুত্ব দিতে হবে। মিয়ানমারকে চাপে রাখতে হবে। প্রত্যাবাসন শুরু হয়ে কোনোভাবে তা যেন বিলম্বিত না হয়। আর রোহিঙ্গা নাগরিকরা বাংলাদেশে আসার পর কী পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে, রায়ে হেরে গেলে মিয়ানমারকে সেই খরচ বছরের পর বছর পরিশোধ করতে হবে। তা ভয়ের ও চাপের হবে মিয়ানমারের জন্য। সেজন্য প্রত্যাবাসনের ‍পুরো প্যাকেজটি আমাদের ধরে ফেলতে হবে অত্যন্ত সচেতনতা ও সতর্কতার সঙ্গে। কোনোভাবেই তড়িঘড়ি নয়।’

আরও পড়ুন : মজুরির চেয়ে খরচ বেশি, বন্দি কিস্তির জালে

এদিকে খুব দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক ড. সি আর আবরার।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ন্যূনতম শর্তগুলোও পূরণ করা হয়নি।  যে সময়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশে আসে, এখন তার চেয়েও খারাপ ও পেশিশক্তির সরকার সেখানে চেপে বসেছে। সেখানে সামরিক শাসন চলছে। কোনো রকম ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি না যে, সেখানে রোহিঙ্গা নাগরিকরা ফিরলে তাদের প্রতি সঠিক আচরণ, নাগরিকত্ব, স্বাধীনতা, অধিকারের শর্ত পূরণ করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কমিউনিটি সেখানে খুব একটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে তাও নয়, তাদের মাথাব্যথা নেই। রাখাইন অঞ্চলে কেবল মাত্র কিছু শেল্টার তৈরি করা হবে, জাপান চীন ও ভারতের সহায়তায়। সেই ভরসায় সেখানে রোহিঙ্গাদের যাওয়ার কোনো কারণ নেই। নিগ্রহের যে সূত্র, সেগুলো রয়ে গেছে মিয়ানমারে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও এখনো অনুকূল মনে হচ্ছে না।’

‘আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) বিচার শুরু করেছে, এটি ইতিবাচক। এটি আমাদের নয়, মিয়ানমারের জন্য চাপের বিষয়। আমাদের দিক থেকে চেষ্টা জারি রাখাই হবে আসল কাজ। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খুব সহসা যে শুরু হচ্ছে না এটা বলাই যায়’— যোগ করেন তিনি।

জেইউ/আরএইচ