অবহেলিত গ্রাম হিসেবে কয়েক বছর আগেও পরিচিতি ছিল খুলনার রূপসা থানার জাবুসা। রূপসার নৈহাটি ইউনিয়নের এ গ্রামটি জোয়ারের লোনা পানিতে নিয়মিত প্লাবিত হয়। লোনা পানিতে ফসল হয় না বলে এখানকার অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। তবে গ্রামের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ গ্রামে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে।

রেনু পোনা থেকে শুরু করে বাগদা, গলদা চিংড়ির পাশাপাশি সাদা পানির মাছ রুই, কাতল, মৃগেল, কালিবাউস, সিলভারকার্প সহ বিভিন্ন কার্প জাতীয় মাছ চাষ হচ্ছে তানভীর ফিসারিজে। লোনা পানির কারণে যাদের জমিতে ফসল কম হয় তারাও আস্থা পাচ্ছে ফিসারিজে।

জাবুসা গ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম লিটু বলেন, তানভীর ফিসারিজ মৎস্য চাষ শুরুর পর গ্রামে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। জোয়ারের লোনা পানির কারণে যেসব জমিতে ফসল হতো না, এখন ওই সব জমিতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সাদা সোনা বা চিংড়ি। আর সাদা মাছ তো আছেই। অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করায় এলাকার গরিব মানুষ সেখানে কাজ করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছে। মানুষ এখানে কাজ করার পাশাপাশি আরও নতুন নতুন খামার গড়ে তুলেছে।

একই কথা বলেন জাবুসা নৈহাটি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বাবর আলী। তিনি বলেন, তানভীর ফিসারিজে চিংড়ি ও সাদা মাছ চাষ সফল হয়েছে। এই এলাকার বহু মানুষ এখানে রোজ ও মাস হিসেবে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। তানভীর ফিসারিজের দেখাদেখি অনেকেই মাছ চাষের স্বপ্ন দেখছে। বেকারদের অনেকে উদ্যোগী হয়ে মাছ চাষে এখন স্বাবলম্বী। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছি।

একই এলাকার বাসিন্দা এস এম আসাফ-উদ-দৌলা বলেন, তানভীর ফিসারিজের কারণে এলাকায় এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। যেখানে মানুষ ফসলি আবাদে অভ্যস্ত ছিল তারা এখন মাছ চাষে উন্নতি করছে।

শুধু জাবুসা গ্রামে নয়, সরেজমিনে দেখা যায়, রূপসার ৩নং নৈহাটি ইউনিয়নের আরও একাধিক গ্রাম ও ২নং শ্রীফলতলা ইউনিয়নে মাছ ও পোল্ট্রি ফার্ম করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে তানভীর ফিসারিজ ও তানভীর পোল্ট্রি ফার্ম। এর উদ্যোক্তা প্রকাশনা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবু সাঈদ।

জাবুসা গ্রামের সেলিম মিয়া বলেন, তানভীর ফিসারিজ ও পোল্ট্রির কারণে বেকার ছেলে-মেয়েদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এখানকার উৎপাদিত মাছ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। উৎপাদিত চিংড়ি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

জাবুসা গ্রামের স্থানীয় মসজিদের ইমাম হাফেজ ক্বারী মাওলানা মো. সৈয়দ ওসমান গনি বলেন, এলাকায় অনেকেরই মাছের ঘের আছে। কিন্তু তানভীর ফিসারিজ আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষে সফলতা দেখিয়েছে। বিষমুক্ত ফিডে মাছ চাষ করছে। তাদের দেখাদেখি এলাকার অনেকে এখন মাছ চাষে সফল।

তানভীর ফিসারিজের ম্যানেজার জাকির হোসেন বলেন, আমাদের প্রকল্পে দিনে দুইবার জোয়ারের পানি আসে। জোয়ার ভাটার কারণে প্রকল্পে মাছ চাষে বেশ সফলতা এসেছে। পাশাপাশি আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে গলদা, বাগদা ও হরিণা চিংড়ি চাষ হচ্ছে। যা বিদেশেও রপ্তানি হয়।

রূপসা উপজেলার সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মো. লিয়াকত আলী বলেন, আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করলে মাছের উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এরা সেটাই করছে। আমরা বিষয়টি সবসময় পর্যবেক্ষণ করছি এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছি। খামারটিকে আমরা একটি মডেল খামার বলতে পারি। এভাবে মাছ চাষ করলে আশা করছি এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা আরও উন্নত হওয়ার পাশাপাশি এলাকায় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আয় করা সম্ভব। স্থানীয় যারা জমির লিজ দিয়েছেন মাছ চাষের জন্য, তারাও তানভীর ফিসারিজের সফলতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।

এদিকে শ্রীফলতলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তানভীর পোল্ট্রির শেড। এখানে বয়লার, লেয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের মুরগি উৎপাদন হয়।

শ্রীফলতলা ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তানভীর পোল্ট্রি ফার্মে দৈনিক ও মাস ভিত্তিতে কাজ করছে এলাকার অনেক বেকার যুবকরা। কোনোরকম অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া এসব খামারে মুরগি ও ডিম উৎপাদন করা হচ্ছে।

উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ কুমার মজুমদার বলেন, অবৈজ্ঞানিক হলে পোল্ট্রি ফার্ম সহজে টেকে না। উন্নত ও বিজ্ঞান সম্মত প্রযুক্তির ব্যবহারে উৎপাদন যেমন বাড়ে তেমনি খরচাও কমে। এ অঞ্চলে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটানোয় তানভীর পোল্ট্রি ফার্ম বড় ভূমিকা পালন করছে। আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দিচ্ছি।

তানভীর পোল্ট্রি ফার্মের ম্যানেজার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এলাকায় তানভীর পোল্ট্রি ফার্মের কারণে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মা সেতুর বদৌলতে ঢাকাসহ সারা দেশেই আমাদের পোল্ট্রির মুরগি-ডিম পৌঁছাতে পারব।

জেইউ/এসএসএইচ