স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাতে যেসব সূচক অর্জন করতে হয়, তার প্রত্যেকটি সূচকেই ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এমন সাফল্যে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নসহ বিনিয়োগ বাড়াবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশেজ্ঞরা।

জানা যায়, নিউইয়র্কে পাঁচ দিনব্যাপী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভা শেষ হয়েছে শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে। সভায় চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশকে  এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে স্বল্পোন্নত দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীলে উত্তীর্ণ হওয়াকে দেশের সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব শতবর্ষের একটি বড় অর্জন বলে মনে করছেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বিশ্বে বর্তমানে ৪৭টি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশের প্রসঙ্গে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. এ. বি. মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করা হলো দেশের অর্থনীতির স্বীকৃতি। যে তিনটি সূচকে উন্নয়নশীল দেশের মান নির্ধারণ করা হয়, তার প্রত্যেকটাতেই অনেক ওপরের দিকে রয়েছে বাংলাদেশ।’

তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের বিষয়টি গৌরবের হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন সংস্থার থেকে অনুদান পাওয়া কমে যাবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়াতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত হবে এবং বিনিয়োগ বাড়বে।‘

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এ অর্জন গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ অর্জনের ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করায় এখন বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ আসবে। যার ফলে পাঁচ বছরের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এ অর্জনে বাংলাদেশে বড় বাজার এবং বিনিয়োগ বাড়াতে আকর্ষণ করবে। দেশের বাইরে বন্ড ও লোনের ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে। চ্যালেঞ্জের মধ্যে- শুল্কমুক্ত সুবিধা কমে আসবে, মেধাসত্ত্ব আইন, দেশীয় মার্কেটে সুবিধা বা উন্নয়ন হবে। এজন্য দেশের নীতিমালা ও আইন পরিবর্তন করে উন্নয়নশীল দেশের শর্তের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের ধারাবাহিকতা রক্ষায় পরিকল্পনা করে দেশের সব ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাজার সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। সুতরাং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হলো। এজন্য সরকারের পরিকল্পিত ইকনোমিক জোনগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ইকনোমিক জোনের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে।’

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘দরিদ্র দেশে থেকে উন্নয়নশীল দেশ হতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় হার্ডেল পার হলো। অর্থাৎ এখন উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নত হলো বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশ হব। আগে ২০২৪ সালে হওয়ার কথা থাকলেও করোনা এবং নতুন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে সেটি ২০২৬ সালে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এই দ্বিতীয় পর্যায়টি অতিক্রম করা আমাদের জন্য গর্বের। ২০১৮ সালের পর থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল। গত তিন বছর আমাদের সূচকগুলো পর্যবেক্ষণ হওয়ার পর সিডিপি চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করেছে। তবে উন্নয়নশীল দেশ হওয়াতে আমাদের জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। বাংলাদেশের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধাও আসবে।’

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, ‘যেহেতু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছি, সেহেতু বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে অনুদান, নো ইন্টারেস্টসহ আরও কিছু সুবিধা সংকুচিত হবে। তবে এগুলো কমলেও আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমরা সবকিছুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধায় উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছি। সুতরাং আমরা এখন স্বাবলম্বী। ফলে সাহায্য-সহায়তা আর না হলেও চলবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন আর কেউ গরিব বলবে না। আমাদের শক্তিশালী রিজার্ভ রয়েছে। প্রতিনিয়তই রেমিট্যান্স আসছে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী। এজন্য অনুদানসহ অন্যান্য সুবিধা ছাড়া আমরা চলতে পারব। এতদিন প্রাথমিকভাবে থাকলেও সিডিপি চূড়ান্তভাবে আমাদের উন্নয়নশীল দেশের জন্য সুপারিশ করেছে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী আগামী তিন বছর পর জাতিসংঘ আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দেবে।’

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, জাতিসংঘের তথ্যানুয়ায়ী বিশ্বের সবগুলো দেশকে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত বা এলডিসি। এলডিসি থেকে উত্তরণে জাতিসংঘ মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা বা সঙ্কট সূচককে বিবেচনায় নেয়। এর আগে ২০১৮ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিলবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সব শর্ত পূরণ হওয়ায় এবারের বৈঠক শেষে সিডিপি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার স্বীকৃতির জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে।

উন্নয়নশীল দেশ হতে কোন কোন সূচকে কত পয়েন্ট লাগে?
উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে প্রয়োজন হয় ৬৬ পয়েন্ট, এ সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান পয়েন্ট ৭৫.৩। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩৬ পয়েন্টের বেশি থাকা দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয়। এর মানে ৩২ পয়েন্টে কোনো দেশ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালকেও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়েছে।

এসআর/এসএম