ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে লোকজন / ছবি: ঢাকা পোস্ট

শাহীনুল ইসলাম, সকাল ৯টার আগ থেকে অপেক্ষা করছেন গাড়ি চালানোর অনুমতির সনদ (ড্রাইভিং লাইসেন্স) পাওয়ার শেষ ধাপ ফিঙ্গারপ্রিন্টের (আঙুলের ছাপ) কাগজ হাতে পেতে। প্রায় ছয় মাসের দৌড়াদৌড়ি আর পরিশ্রমের পর ডাক পেয়েছেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার জন্য। অথচ পাশেই বসে থাকা মইন উদ্দিন এক মাসের মাথায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে ডাক পেয়েছেন।

শাহীনুল ইসলামকে বিআরটিএ’র কার্যালয়ে আসতে হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু এবার দিয়ে মাত্র দুবার আসতে হয়েছে মইন উদ্দিনকে। দুজনেই ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার অনুমতির কাগজ হাতে পান। মঙ্গলবার (২ মার্চ) রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ী এলাকায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৩ এ সকাল সাড়ে ১০টায় দেখা গেল এমন চিত্র।

ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষার ফিল্ডটেস্ট দেওয়ার অপেক্ষা / ছবি: ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে শাহীনুল ইসলাম ও মইন উদ্দিনের একই বিষয়ে সময়ব্যয় এবং ওই অফিসে যাতায়াতের পার্থক্যের বিষয়টি জানা যায়। শাহীনুল নিজ দায়িত্বে কোনো মাধ্যম ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গিয়ে এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর মইন উদ্দিন একজন দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স।

শাহীনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা অন্যরকম এক অফিস। এখানে না এলে কেউ বুঝতে পারবেন না। কারও কাছ থেকে পাওয়া যায় না কোনো তথ্য। সহযোগিতা তো দূরের কথা, কেউ কাউকে তথ্যও দিতে চান না। নিজে নিজে করতে গিয়ে টের পাওয়া যাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে কতটা সময় আর পরিশ্রম করতে হয়।’

তিনি বলেন, আজ নিয়ে পাঁচবারের বেশি সময় এখানে আসতে হয়েছে। আগস্ট মাসের শেষ দিকে মোটর ও হালকা পরিবহনের (মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার) ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি। খরচ হয়েছে সবমিলিয়ে ১৮০০ টাকার মতো। আজ চলছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার শেষ ধাপের কাজ। 

শাহীনুলের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি কতটা বিরক্ত। অথচ মইন উদ্দিন আছেন খোশমেজাজে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘আব্দুল্লাহ নামের একজনকে টাকা দিয়েছিলাম। উনিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধু স্বাক্ষর ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে আসতে হয়েছিল। আমরা কয়েকজন মিলে তার মাধ্যমে চালকের সনদ নেওয়ার জন্য টাকা জমা দেই। সবাই আজ ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছি। সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার টাকা।’

এ-তো গেল দুজনের অভিজ্ঞতার কথা। সকাল থেকে এক ঘণ্টা দিয়াবাড়ী বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৩ ঘুরে এবং একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে বিড়ম্বনার এমন অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। সবারই বক্তব্য, দালালের মাধ্যমে করলে সহজেই মিলছে ড্রাইভিং লাইসেন্স। দালাল ছাড়া নিজে করতে গেলে সময় লাগে বেশি, পরিশ্রমও হয় প্রচুর।

আব্দুল্লাহ নামের একজনকে টাকা দিয়েছিলাম। উনিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধু স্বাক্ষর ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে আসতে হয়েছিল। আমরা কয়েকজন মিলে তার মাধ্যমে সনদ নেওয়ার জন্য টাকা জমা দেই। সবাই আজ ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছি। সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার টাকা

মইন উদ্দিন, লাইসেন্সপ্রত্যাশী

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৮টার পর থেকেই নিবন্ধনের জন্য ভিড় জমাতে শুরু করেন আগামী দিনের গাড়িচালকেরা। কেউ টাকা জমা দিচ্ছেন, কেউ অপেক্ষা করছেন ফিঙ্গারপ্রিন্টের অনুমতির জন্য। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার মৌখিক পরীক্ষার ডাক পেয়ে অপেক্ষা করছেন। এখানে নতুন যারা আসছেন তারা শুরুতে বুঝেই উঠতে পারছেন না কী করবেন।

এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থানকালে কথা হয় অন্তত ১০ জনের সঙ্গে। সবাই জানালেন, দালাল ধরলে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্স। তা না হলে অপেক্ষা আর হয়রানি সহ্য করতে হয়। সহজেই মেলে না কোনো সহযোগিতা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের অফিসে কর্মরত আশরাফুল আলম, বিআরটিএ’র একজন নারী কর্মকর্তা, গাড়িচালক নজরুল ইসলামসহ অনেকেই এখানে কাজ করেন মাধ্যম (দালাল) হিসেবে।

দালাল ধরলে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্স। তা না হলে অপেক্ষা আর হয়রানি সহ্য করতে হয়। সহজেই মেলে না কোনো সহযোগিতা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের অফিসে কর্মরত আশরাফুল আলম, বিআরটিএ’র একজন নারী কর্মকর্তা, গাড়িচালক নজরুল ইসলামসহ অনেকেই এখানে কাজ করেন মাধ্যম (দালাল) হিসেবে

কেন দালালদের সহযোগিতা নিচ্ছেন— জানতে চাইলে নিবন্ধনপ্রত্যাশীরা জানান, সময় ও হয়রানি থেকে বাঁচতেই দালাল ধরতে বাধ্য হচ্ছেন। শামীম হোসেন নামের একজন বলেন, আমি তো একটা চাকরি করি। একাধিক দিন এখানে কীভাবে আসব? এ কারণে সব ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিচ্ছি।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, এখানে কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। সব এলোমেলো। সহজেই কোনো তথ্য পাচ্ছেন না সেবাপ্রত্যাশীরা। দালাল ছাড়া নিজেরাই যারা কাগজপত্র নিয়ে চেষ্টা করছেন, তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন কিন্তু সমাধান পাচ্ছেন না। ফোনে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে পরামর্শ। আর যারা দালালের পকেটে টাকা গুঁজে দিচ্ছেন, তারা আছেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে।

একে/এইচকে/এমএআর