মিরপুর বিআরটিএ-এর পাশেই অবস্থিত এসব ফটোকপির দোকান / ছবি: ঢাকা পোস্ট

লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ জমা দিচ্ছেন আবেদনপত্র, কেউ দিচ্ছেন ফিঙ্গার প্রিন্ট। কেউবা লাইনে দাঁড়িয়েছেন লাইসেন্সের ডেলিভারি নিতে। এসব দেখে মুহূর্তেই মনে হবে লাইসেন্স নিয়ে মহাযজ্ঞ চলছে রাজধানীর মিরপুরের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ে।

কিন্তু এই কর্মযজ্ঞের আড়ালে থাকা ভোগান্তি আর অনিয়মের কালো রঙ ধরা পড়বে না সাদা চোখে। আপাত দৃষ্টিতে ভেতরে মহা কর্মযজ্ঞ দেখা গেলেও লাইসেন্স পাওয়ার আসল কাজ হয় বিআরটিএ কার্যালয়ের বাইরে, পশ্চিম পাশের ফটোকপির দোকানগুলোতে। সেখানে দালালদের সঙ্গে লাইসেন্স পাওয়ার চুক্তি করেন প্রত্যাশীরা। দালাল ছাড়া মাসের পর মাস লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও লাইসেন্স পাওয়ার আশা ক্ষীণ।

যারা দ্রুত ও সময়মতো লাইসেন্স পেতে চান তাদের অবশ্যই এসব দোকানে বসে থাকা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তা না হলে আবেদন করে ৮-৯ মাসেও পরীক্ষা বা ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার ডাক মেলবে না। মঙ্গলবার (২ মার্চ) রাজধানীর মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয় চত্বর ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসেছেন ইসমাইল। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, ভোগান্তি ছাড়াই লাইসেন্স পেতে বিআরটিএ অফিসে নয়, যেতে হবে পাশের ফটোকপির দোকানগুলোতে। বিআরটিএ’র ভেতরে আবেদনপত্র ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে যাদের দেখছেন তাদের অধিকাংশই মূল কাজ বাইরের ফটোকপির দোকানে দালালের মাধ্যমে সেরে এসেছেন

সরেজমিনে দেখা যায়, মিরপুরের বিআরটিএ কার্যালয়ের পশ্চিম পাশে থাকা ফটোকপির দোকানগুলোতে লাইসেন্সপ্রত্যাশীদের ভিড়। তারা এসব দোকানে গিয়ে দালালদের সঙ্গে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করছেন। চুক্তি শেষে দালালরা তাদের বিভিন্ন গলির চিপায় নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে হচ্ছে টাকার লেনদেন।

লাইসেন্সপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফটোকপির দোকানে বসা দালালদের সঙ্গে চুক্তি করলে ২-৩ মাসের মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া যায়। স্পটে এসে তাদের সঙ্গে চুক্তি করেন অনেকে। আবার পুরনো ‘কাস্টমারের’ রেফারেন্সেও আসেন কেউ কেউ।

সোমবার যোগাযোগমন্ত্রী বিআরটিএ পরিদর্শন করে গেছেন। এছাড়া বিআরটিএ’র বিশেষ সেবা সপ্তাহ চলছে। এখন দ্রুত লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব নয়। সেবা সপ্তাহ শেষ হলে যোগাযোগ করবেন

দালাল মাসুদ

কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসেছেন ইসমাইল। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, ভোগান্তি ছাড়াই লাইসেন্স পেতে বিআরটিএ অফিসে নয়, যেতে হবে পাশের ফটোকপির দোকানগুলোতে। বিআরটিএ’র ভেতরে আবেদনপত্র ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে যাদের দেখছেন তাদের অধিকাংশই মূল কাজ বাইরের দালালদের মাধ্যমে সেরে এসেছেন।

‘আমারও ড্রাইভিং লাইসেন্স করা প্রয়োজন কিন্তু কোনো উপায় মিলছে না’— জানালে ইসমাইল এই প্রতিবেদককে বিআরটিএ কার্যালয়ের পশ্চিম পাশের ফটোকপির দোকানে নিয়ে যান। ‘চাঁদপুর বিজনেস সেন্টার’ নামের একটি ফটোকপির দোকান থেকে মাসুদ নামে এক দালালকে ডেকে আনেন তিনি।

মাসুদ এসে বলেন, কীভাবে সাহায্য করতে পারি? দ্রুত লাইসেন্স পাওয়ার কথা জানালে তিনি বলেন, “সোমবার যোগাযোগমন্ত্রী বিআরটিএ পরিদর্শন করে গেছেন। এছাড়া বিআরটিএ’র বিশেষ সেবা সপ্তাহ চলছে। এখন দ্রুত লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব নয়। সেবা সপ্তাহ শেষ হলে যোগাযোগ করবেন।” এরপর তিনি মোবাইল নম্বর দেন।

কত দিনে লাইসেন্স দিতে পারবেন— জানতে চাইলে বলেন, ‘দুই মাস তো লাগবেই।’ ইসমাইল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘ভাইয়ের (মাসুদ) কথা ও কাজের মিল আছে।’

ঠিক ওই সময় কয়েকজন কাগজপত্র নিয়ে হাজির হন। তাদের কাজ করে দেওয়ার কথা বলে প্রত্যেকের সঙ্গে আট হাজার টাকার চুক্তি করেন মাসুদ। আবেদনের সঙ্গে অর্ধেক, বাকি টাকা ফিঙ্গার প্রিন্টের আগে দিতে হবে বলে জানান মাসুদ।

প্রথমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু পাঁচ মাস পরও পরীক্ষা ও ফিঙ্গার প্রিন্টের তারিখ না আসায় দালাল ধরেছি। ফটোকপির দোকানের সাত্তার নামের এক দালালের সঙ্গে ২২ হাজার টাকায় চুক্তি করি। চুক্তির এক মাস পর ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসেছি

ভুক্তভোগী মো. আমির

হালকা যানবাহনের লাইসেন্স করাতে দালালরা আট থেকে নয় হাজার টাকা নিলেও ভারী যানবাহনের ক্ষেত্রে নেন ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। এ ধরনের লাইসেন্স নিতে এসেছেন মো. আমির। জানালেন, প্রথমে তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু পাঁচ মাস পরও পরীক্ষা ও ফিঙ্গার প্রিন্টের তারিখ না আসায় দালাল ধরেন। ফটোকপির দোকানে সাত্তার নামের এক দালালের সঙ্গে ২২ হাজার টাকায় চুক্তি করেন। চুক্তির এক মাস পর ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসেছেন।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, চুক্তির সময় ১১ হাজার আর আজ (মঙ্গলবার) ১১ হাজার টাকা দিয়েছি। দালালদের সঙ্গে চুক্তি ছাড়া কেউই লাইসেন্স পান না এখানে।

জানা গেছে, নয় লাখের বেশি লাইসেন্সপ্রত্যাশী ইতোমধ্যে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছেন এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছেন। তবে সরবরাহ বন্ধ থাকায় অভিযোগ ও ভোগান্তি ছিল অনেক। এ বিষয়ে বিআরটিএ বলছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা বন্ধ ছিল। সেবা চালুর পর চাপ আরও বেড়েছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রিন্টিং বন্ধ থাকায় ঝুলতে থাকা প্রত্যাশীর সংখ্যা এখন প্রায় নয় লাখ। যদিও এ সময়ে প্রায় দুই লাখ কাগুজে ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করা হয়েছে।

ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়ে বিআরটিএ’র মুখপাত্র (পরিচালক, রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, “আগে বিআরটিএ’র সঙ্গে চুক্তি ছিল টাইগার আইটি’র। তারা বাদ যাওয়ার পর দুবার টেন্ডার হয়। গত বছরের ২৯ জুলাই পাঁচ বছরের জন্য মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়। প্রতিষ্ঠানটি মেশিনারিজ, সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার স্থাপনের কাজ শেষ করেছে। শুরু হয়েছে লাইসেন্সপ্রার্থীদের আঙুলের ছাপ নেওয়ার কার্যক্রম।”

তিনি আরও বলেন, ‘আগে যারা আবেদন করেছেন অর্থাৎ বেশি সময় অপেক্ষায় থাকা প্রত্যাশীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন। আমরা চার ভাগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। প্রথমে নির্দিষ্ট চার জেলায়, এরপর বিভাগীয় জেলা শহর, ঢাকা মেট্রো এবং পরবর্তীতে সারাদেশে একযোগে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আঙুলের ছাপ নেওয়ার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ করা হবে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স।’

ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে যা করতে হয়

অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ন্যূনতম ১৮ বছর এবং পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম ২০ বছর বয়সীরা আবেদন করতে পারবেন। লাইসেন্স দেওয়া হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে।

ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রথম ধাপ হলো- শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সের (লার্নার) জন্য আবেদন করা। প্রথমে এর জন্য বিআরটিএ থেকে বা ওয়েবসাইট থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জমা দেওয়া।

শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র-

১. নির্ধারিত ফরমে আবেদন। 
২. রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের দেওয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট। 
৩. ন্যাশনাল আইডি কার্ড/জন্মসনদ/পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি। 
৪. নির্ধারিত ফি, ক্যাটাগরি ১- ৩৪৫ টাকা ও ক্যাটাগরি ২- ৫১৮ টাকা বিআরটিএ’র নির্ধারিত ব্যাংকে (ব্যাংকের তালিকা www.brta.gov.bd তে পাওয়া যাবে) জমাদানের রশিদ। ক্যাটাগরি ১- শুধু মোটরসাইকেল অথবা শুধু হালকা মোটরযান। ক্যাটাগরি ২- মোটরসাইকেল এবং হালকা মোটরযান একসঙ্গে। 
৫. সদ্য তোলা তিন কপি স্ট্যাম্প ও এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।

এরপর আবেদনপত্রটি নিজ হাতে পূরণ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ নিজ এলাকা অনুযায়ী বিআরটিএ’র সার্কেল অফিসে জমা দিতে হবে। সার্কেল অফিস থেকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেবে। এরপর তাদের দেওয়া সময় অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। এ সময় লার্নারের মূল কপি নিয়ে যেতে হবে।

লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ড টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুনরায় একটি নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ফি দিয়ে স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিসে আবেদন করতে হবে। গ্রাহকের বায়োমেট্রিক (ডিজিটাল ছবি, ডিজিটাল স্বাক্ষর ও আঙুলের ছাপ) গ্রহণ করে স্মার্ট কার্ড ইস্যু করা হয়। স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্টিং সম্পন্ন হলে গ্রাহককে এসএমএসের মাধ্যমে তা গ্রহণের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করার পর বিআরটিএ একটি প্রাপ্তি রিসিট গ্রাহককে দেবে। যা স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স না পাওয়া পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স হিসেবে গণ্য হবে।

স্মার্ট কার্ড লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

১. নির্ধারিত ফরমে আবেদন। 
২. রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের দেওয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট। 
৩. ন্যাশনাল আইডি কার্ড/জন্মসনদ/পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি। 
৪. নির্ধারিত ফি (পেশাদার- ১৬৮০ টাকা, অপেশাদার- ২৫৪২ টাকা) বিআরটিএ’র নির্ধারিত ব্যাংকে জমাদানের রশিদ। 
৫. পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন। 
৬. সদ্য তোলা এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।

অপেশাদার লাইসেন্স ১০ বছর পরপর নবায়ন করাতে হবে। পেশাদার লাইসেন্স ৫ বছর পরপর নবায়ন করাতে হয়।

এমএসি/এইচকে/এমএআর