শুকনো মৌসুমে তিস্তায় পানি প্রবাহ থাকে অস্বাভাবিক কম/ সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ব্যাখ্যায় দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের প্রায়ই সোনালী অধ্যায়ের কথা বলতে শোনা যায়। দুই বন্ধুপ্রতীম দেশ সম্পর্কের সেরা সময়ে অবস্থান করলেও পাওয়া না-পাওয়ার বিষয়টি মাঝেমধ্যেই অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে অমীমাংসিত কিছু বিষয়; বিশেষ করে পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্যে অসমতাসহ আরও কিছু বিষয় সামনে চলে আসে।

এক দশক ধরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বারবার আটকে যাচ্ছে। তিস্তার জট খোলা নিয়ে প্রতিনিয়ত ঢাকার পক্ষ থেকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও অনিশ্চয়তার মেঘ কাটছেই না, হচ্ছে না তিস্তা চুক্তি। আর এ নিয়ে ঢাকা-নয়াদিল্লির সম্পর্কের সোনালী অধ্যায়ের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে সেটা মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। 

• এক দশক ধরে আটকে আছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি
• মমতাই এখনো বাধা, তাকে বাগে আনতে পারেননি মোদি
• তিস্তা ইস্যু সমাধান না করতে পারায় শেখ হাসিনার কাছে মোদির লজ্জা প্রকাশ
• ২৭ মার্চ হাসিনা-মোদির বৈঠকে তিস্তার প্রসঙ্গ জোরালোভাবে তুলবে বাংলাদেশ
• তিস্তার সমাধানে পশ্চিমবঙ্গকে মোদি সরকারকেই বাগে আনতে হবে

প্রায় হতে গিয়েও না হওয়া তিস্তা নিয়ে ভারতের সরকারের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, তিস্তা চুক্তিতে তারা কোনো বাধা দেখছে না। এ নিয়ে তারা চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে একা এটির সুরাহা করা সম্ভব না, এক্ষেত্রে এখনও পশ্চিমবঙ্গকে রাজি করাতে পারছে না কেন্দ্রীয় সরকার।

অন্যদিকে ঢাকাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। নয়া দিল্লির প্রধান থেকে শুরু করে দেশটির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে বৈঠক-সাক্ষাৎ, টেলিফোন কিংবা রাষ্ট্রীয় সফরে তোলা হচ্ছে তিস্তা ইস্যু। শুধু তাই নয়, দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত দূতকে পেলেও তোলা হচ্ছে তিস্তার বিষয়টি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নয়াদিল্লির সঙ্গে যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে একে একে দরা-কষাকষির মাধ্যমে প্রতিটি সমস্যার বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান চায় ঢাকা। এক্ষেত্রে তিস্তাকে বরাবরই মূল ফোকাসে রাখা হয়। তবে এই সমস্যার সমাধান না আসার কারণে অন্য সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখতে চায় না সরকার।

সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ঢাকা আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারই সফর চূড়ান্ত করতে আজ বৃহস্পতিবার এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় আসছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর। মূলত মোদির ঢাকা সফর চূড়ান্ত, দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক, প্রকল্প, চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আলোচনা করবেন জয়শঙ্কর। এই সুযোগে তিস্তার বিষয়টিও তুলবে ঢাকা।

শুকনো মৌসুমে তিস্তা/ সংগৃহীত ছবি

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, জয়শঙ্করের সফরে তিস্তার বিষয়টি বোনাস হিসেবে তোলা হবে। তবে আগামী ২৭ মার্চ হাসিনা-মোদির উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে তিস্তার প্রসঙ্গটি বেশ জোরালোভাবেই তুলবে ঢাকা।

এ বছরই তিস্তা নিয়ে সুখবরের সম্ভাবনা নেই। তবে ছয় নদীর সুরাহার সুসংবাদ আসতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক সূত্র

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক সূত্র বলছে, দুই দেশের পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে চলতি বছরেই তিস্তা জট খোলা নিয়ে কোনো সুখবর আসার সম্ভাবনা নেই। তবে ছয়টি অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে সুরাহার সুসংবাদ আসতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তিস্তার জট খোলা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ঢাকা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। তবে তিস্তার সমাধানে পশ্চিমবঙ্গকে মোদি সরকারকেই বাগে আনতে হবে। একইসঙ্গে তারা খুব সহসাই তিস্তার সম্ভাবনা দেখছেন না। 

আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন

তিস্তার জট কবে খুলতে পারে- জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী, তিস্তা ইস্যুর সমাধান হবে। তবে দিনক্ষণ বলার বিষয় না এটা।’

বর্তমান সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিনিময় হয়েছে ছিটমহল, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রায় ১০ হাজার একর জমি বেশি পেয়েছে। দুই দেশের জলসীমান্তও চূড়ান্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে। এই সরকারের আমলে সীমান্ত হত্যাও কমে প্রায় শূন্যে নেমেছে। তবে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা রয়েই গেছে। আর এই পানিবণ্টন চুক্তি কয়েক বছর ধরে আটকে আছে মমতার আপত্তিতে। তার দাবি, বাংলাদেশকে পানি দিলে তার রাজ্য পর্যাপ্ত পানি পাবে না।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে হচ্ছে না তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘খুবই সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের কারণে তিস্তা ইস্যুর সমাধান হচ্ছে না। আমাদের পক্ষ থেকে ব্যর্থতার কোনো কিছু দেখি না। চুক্তির নীতিগত সবকিছু ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল এবং প্রায় সই হয়ে যাওয়ার মতো একটা আবহ কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে এটা সম্ভব হয়নি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তো আমাদের বিষয় না। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কী হবে না-হবে সেটা দেখার দায়িত্ব ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের।’

‘আমাদের সঙ্গে তারা একটা চুক্তি করবে, এটাতে তাদের দেশ থেকে বাধা এলে আমাদের কিছু করার নাই। আমরা তো পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এটা নিয়ে নেগোসিয়েট (দরকষাকষি) করব না, এটার নেগোসিয়েট (দরকষাকষি) করতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে। তবে ভারত ভোটের ইস্যুতে বাংলাদেশের চাইতে তাদের দলীয় স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, এটা দুঃখজনক।’

তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিটি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেই ২০১১ সালে। সে সময়ের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে চুক্তি সইয়ের বিষয়টি চূড়ান্তও ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে আটকে যায়। সেই মমতাই এখনো বাধা হয়ে আছেন। তাকে বাগে আনতে পারেননি মোদি। 

বহুপ্রতীক্ষিত তিস্তার জট খোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরকে ঘিরে। ওই বছরের ৭ থেকে ১০ এপ্রিলের সফরে ৩৫টি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। তবে সেখানে ছিল না তিস্তার প্রসঙ্গ। ওই সফরের দ্বিতীয় দিন ৮ এপ্রিল শেখ হাসিনা সরকার এই চুক্তি করার অঙ্গীকার করেছিলেন।

২০১৮ সালের মার্চে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভারত সফরেও তিস্তা চুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেসময় আবদুল হামিদকে মোদি জানান, এ বিষয়ে মমতাকে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। একই বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পশ্চিমবঙ্গ সফরকে ঘিরেও তিস্তার প্রসঙ্গ সামনে আসে। যদিও এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল অন্য। তারপরও মোদির সঙ্গে তার এক ঘণ্টার একান্ত বৈঠক এবং পরে মমতার সঙ্গে আধা ঘণ্টার আলাপনে তিস্তা নিয়ে নাটকীয় কোনো ঘোষণা আসেনি।

তিস্তার সুরাহা রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে।

সিইজিআইএস ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান তিস্তা প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদির সফরে তিস্তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে এবার তিস্তা হবে এই আশা করা ঠিক হবে না। তিস্তার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের চুক্তি ছিল কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজি হলো না। মনে রাখতে হবে, এগুলো ডায়লগ, এগুলো কনটিনিউ (চালিয়ে) করে যেতে হয়। কোনো মিটিং থাকলেই এই বিষয়গুলো উত্থাপন করে যেতে হয়, উত্থাপন হলে হয়তো একটা সময় সমাধানটা আসতে পারে।’

তিস্তার সমাধানের উপায় জানতে চাইলে পানি নিয়ে কাজ করা এই বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, তিস্তার সুরাহা রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। কেননা, টেকনিক্যাল লেভেলের সুরাহা হয়ে গেছে। 

এদিকে গত মঙ্গলবার (২ মার্চ) মোদির সফরে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি বাংলাদেশের অগ্রাধিকারে থাকবে কিনা- জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, এটা আমাদের সব সময়ের প্রায়োরিটি।

তিস্তা নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার খুব দৃঢ়ভাবে কাজ করছে।

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় দূত বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় দূতদের প্রতিনিয়ত তিস্তা জট নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমান দূত বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে জানান, তিস্তা চুক্তির সমাধান ভারতের রাজ্য সরকারের কারণে হচ্ছে না। তবে তিস্তার হিস্যা ঢাকাকে বুঝিয়ে দিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। তিস্তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার খুব দৃঢ়ভাবে কাজ করছেন বলেও জানান হাইকমিশনার। 

বিদায়ী বছরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভার্চুয়াল আলোচনায় তিস্তা ইস্যু নিয়ে আগের মতো আশ্বাস দেয় নয়াদিল্লি। তবে তিস্তা ইস্যু সমাধান না করতে পারায় শেখ হাসিনার কাছে লজ্জা প্রকাশ করেন মোদি। 

সবশেষ গত ২৯ জানুয়ারি ভারতের হায়দ্রাবাদ হাউজে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার নেতৃত্বে দুই দেশের ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) শীর্ষক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে ঢাকা তিস্তা চুক্তি সমাধানে নয়াদিল্লিকে অনুরোধ করে। জবাবে, নয়া দিল্লি ঢাকাকে আগের মতোই চুক্তি সমাধানে আশ্বস্ত করে। ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তার বিষয়ে জানানো হয়, তিস্তা চুক্তি সমাধানের চিন্তা করা হচ্ছে। তবে ছয়টি অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধান প্রথমে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

এনআই/এইচকে