হারানো এক বন্ধুর খোঁজে আজও আকুল সুফি মিজানুর রহমান
আলহাজ্ব সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান/ ছবি: ইমরান হোসাইন
জীবনে চলার পথে প্রতিটি মানুষের বন্ধু নামের বিশ্বাসী ও মজবুত একটি সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। আর এ সম্পর্ক কখনো লাভ অথবা ক্ষতির ভাবনায় তৈরি হয় না। বরং এ সম্পর্কগুলো তৈরি হয় আত্মার আত্মিক স্থল থেকে। একে-অপরের সুখ দুঃখের গল্পের ঝুলি ভাগাভাগি করে নেওয়ার নামই তো বন্ধুত্ব।
সময়ের পরিক্রমায় মানুষ যেমন খুঁজে পায় নতুন নতুন বন্ধু, তেমনি আবার হারিয়েও ফেলে পুরনো বন্ধুদের। পুরনো বন্ধুর খোঁজে এমনই এক বিরল স্মৃতিকে ধারণ করে আছেন হালের অন্যতম শিল্পপতি আলহাজ্ব সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
বিজ্ঞাপন
পিএইচপি পরিবারের এ চেয়ারম্যান যেন সর্বস্বের বিনিময়ে হলেও একবার এ হারানো বন্ধুটিকে সচক্ষে দেখতে চান। জানতে চান এখন কেমন আছেন তিনি! দীর্ঘ ৫৬ বছর পর কোন সে বন্ধুর খোঁজে সুফি মিজানুর রহমান? কেনোই বা তার স্মৃতি রোমন্থনে তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন বারবার?
এর পেছনে রয়েছে এক অবিশ্বাস্য ঘটনাও। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির বহুতল একটি বাসভবনে একান্ত সাক্ষাৎকারে সে গল্পটি বললেন সুফি মিজানুর রহমান।
কথায় আছে একটি বই হাজার বন্ধুর সমান। কিন্তু সুফি মিজানুর রহমানের মতো একজন সত্যিকারের ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরির সমান।
বিজ্ঞাপন
১৯৬৪ সাল। মিজানুর রহমান তখন নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের ছাত্র। সেই কলেজে পড়া অবস্থায় পরিচয় হয় বিশেষ বন্ধুটির সঙ্গে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব আরও গভীর হতে শুরু করে। দুই বন্ধুর ভালোই দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন মিজানুর রহমানের বিশেষ সেই বন্ধুটি একটি চাকরির খবর নিয়ে এলেন। চাকরিটি ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের জুনিয়র ক্লার্ক পদের জন্য। এবার বন্ধুর অনুপ্রেরণায় মিজানুর রহমানও একটি আবেদন লিখে জমা দিলেন। পরবর্তী ধাপে লিখিত পরীক্ষার ডাকও পেলেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা আসার জন্য ৪ আনা অর্থও ছিল না মিজানুর রহমানের। আশা ছেড়ে দিলেন তিনি। কিন্ত এবারও বিশেষ বন্ধুটি সাহায্য নিয়ে হাজির। ব্যাস, দুজনে মিলে পরীক্ষা দিতে চলে গেলেন ঢাকায়।
পরীক্ষায় মিজানুর রহমান উত্তীর্ণ হলেও বিশেষ বন্ধুটি উত্তীর্ণ হতে পারেননি। চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির পাড়ে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের অফিসে যোগদান করার সময় বন্দরনগরীখ্যাত চট্টগ্রামে তার আসার ট্রেন ভাড়াও ছিল না। সে বন্ধুই তাকে ১ আনা দেন।সেটি নিয়েই সুফি মিজান পা রাখেন চট্টগ্রামে। এরপর আর কখনও তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অবিরত কর্ম, মেধা ও সততার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছেন সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে। প্রতিষ্ঠিত করেছেন দেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মস্থল পিএইচপি ফ্যামিলি। ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকেও।
তার ভাষায় আজকের সবকিছুর পেছনে সে বন্ধুটির উপকার ছিল। বাংলাদেশের বৃহৎত্তম এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়েও ভুলতে পারিনি বন্ধুর ঋণ। তাইতো ৫৬ বছর পর নিরন্তরভাবে খুঁজে চলেছেন সেই বন্ধুটিকে। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে সে বন্ধুটি না থাকলে আজ এ অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম না। সেদিন যদি সে আমাকে ঢাকায় না নিয়ে আসতো তাহলে আমি পরীক্ষাটি দিতে পারতাম না। বন্ধুর কাছে আমি চিরঋণী ও চির কৃতজ্ঞ থাকব।’
‘বন্ধুর খোঁজ’ শিরোনামে একটি পোস্টারে এরইমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায়ও খোঁজ চালানোর ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সুফি মিজানুর রহমান প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
সুফি মিজানুর রহমান একজন মহৎপ্রাণ ও উদার ব্যক্তিত্বের অনন্য দৃষ্টান্ত। শুধুই কি তাই? সাদামাটা ও অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত তিনি। তাই তো সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষদেরও সহজেই কাছে টেনে নেন, আলিঙ্গন করেন। তার মতে আমাদের সমাজের ব্যাধি কেবল ক্যানসার নয়, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও মমতা না থাকা হলো সবচেয়ে বড় ব্যাধি। সুফি মিজানুর রহমানের মতো সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও মায়ার বন্ধন দৃঢ় হতে পারলে কতই না সুন্দর হতো আমাদের পৃথিবী।
জেডএস