তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ইন্টারনেটকেন্দ্রিক যেকোনো অপরাধমূলক কাজ নিয়ন্ত্রণে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট গঠনের দাবি জানানো হয়েছে। যার নাম হবে ‘পুলিশ সাইবার ব্যুরো’। পাশাপাশি পুলিশের জন্য স্বতন্ত্র বিভাগ, স্বতন্ত্র ইউনিভার্সিটি গঠন, ডিএমপি কমিশনার ও র‌্যাবের ডিজিসহ পুলিশ বাহিনীতে সচিব পদমর্যাদার ১০টি পদ ‘গ্রেড- ১’ সৃজনের দাবি জানানো হয়েছে।

এবারের পুলিশ সপ্তাহে পুলিশের পক্ষ থেকে এসব দাবি-দাওয়াসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব উপস্থাপন এবং পুরোনো দাবিগুলো পূরণের তাগিদ দেওয়া হয়। পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩ এর শেষদিন শনিবার (৭ জানুয়ারি) রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন।

রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মিলনায়তনে রাত ৮টার দিকে শুরু হয় এ সভা। চলে রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত। পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান। এতে বিভিন্ন মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, জেলা পুলিশ সুপার, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান, পুলিশ সদরদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

সভায় পুলিশের ১১ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পুলিশের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন।

পুলিশ সাইবার ব্যুরো গঠনের দাবি

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ রোধ ও তদন্তে শুধুমাত্র ডিএমপিতে (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ) পুলিশের আলাদা ইউনিট রয়েছে। জেলাপর্যায়ে কোথাও নেই। ডিবি পুলিশের একটা অংশ কাজ করে। বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ রোধে আলাদা ইউনিট গঠন প্রয়োজন।

যার নাম হতে পারে পুলিশ সাইবার ব্যুরো। একজন অতিরিক্ত আইজিপির নেতৃত্বে বিদ্যমান পুলিশ কাঠামোয় থেকে স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত ইউনিট হিসেবে কাজ করবে। এ ইউনিটের অধীনে পিবিআই-এর আদলে প্রতি জেলায় সাইবার ক্রাইম ইউনিট গঠন করা হবে। জেলায় নেতৃত্বে থাকবেন একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তার অধীনে থাকবেন দুজন এএসপি, চারজন ইন্সপেক্টর, আটজন এসআই, ১৬ জন এএসআই। এর সঙ্গে থাকবে সাপোর্ট ফোর্স। জেলা সাইবার টিম জেলার এসপি ও বিভাগীয় প্রধানদের মাধ্যমে সাইবার ব্যুরো অফিসকে রিপোর্ট করবে।

বৈষম্য নিরসনে পৃথক পুলিশ বিভাগ গঠনের দাবি

বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসার ব্যাটালিয়নের মূল দপ্তরকে বলা হয় সদরদপ্তর। কিন্তু পুলিশের সদরদপ্তরকে বলা হচ্ছে পুলিশ অধিদপ্তর। সভায় কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হলে আইজিপি মন্ত্রণালয়ে বসেই সিনিয়র সচিবের ভূমিকা পালন করতে পারবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানও অর্থ মন্ত্রণালয়ে বসে সিনিয়র সচিবের ভূমিকা পালন করেন। আইজিপির পদটি সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবও একই পদমর্যাদার।

পুলিশের ছুটি, বদলির মতো কাজগুলো এখন জননিরাপত্তা বিভাগের মাধ্যমেই করা হয়। পুলিশের চাওয়া এসব কাজ আইজিপির অধীনেই হোক। পুলিশকে অধীনস্থ দপ্তর হিসেবে ভাবাটা কলোনিয়াল চিন্তা। প্রায় তিন লাখ সদস্যের এ বাহিনীকে পৃথক বিভাগ বা স্বতন্ত্র অধিদপ্তর  হিসেবে গঠনের দাবি জানানো হয়।

পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের দাবি

সারা পৃথিবীতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশেও ফরেনসিক কিংবা সাইবার সিকিউরিটি, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমন, বিট পুলিশিং, জেন্ডার ইকুয়ালিটি পুলিশিংয়ের জন্য ‘পুলিশ ইউনিভার্সিটি’ বা ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্রিমিনাল/ক্রাইম অ্যান্ড সিকিউরিটি’ নামে পুলিশের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের দাবি উত্থাপন করা হয়। 

এছাড়া পুলিশ বাহিনীর জন্য আলাদা মেডিকেল কোর গঠনের দাবি পুরোনো। সেটি নতুন করে উত্থাপন করেন কর্মকর্তারা। গত বছরের পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এ দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। এটি দ্রুত বাস্তবায়নে জোর তাগিদ দেওয়া হয় কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে।
 
পার্বত্য এলাকার নিরাপত্তায় এপিবিএন ব্যাটালিয়ন গঠনের দাবি

পার্বত্য শান্তিচুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা। সেটি শুরু হলেও নিরাপত্তায় পুলিশকে দায়িত্ব দেবার প্রতিশ্রুতি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এক্ষেত্রে পার্বত্য এলাকায় তিনটি আলাদা এপিবিএন ব্যাটালিয়ন গঠন করার কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এ বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। এবার সেটি দ্রুত গঠন ও বাস্তবায়নের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রস্তাব দেওয়া হয়।

দূতাবাসে পুলিশ কর্মকর্তার পদায়ন দাবি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ৬০টিরও বেশি দূতাবাস ও মিশন রয়েছে। কোনো কোনো দেশে দূতাবাসের কার্যক্রম রয়েছে একাধিক শহরে। এসব দূতাবাস ও মিশনে অ্যাম্বাসেডর বা হাইকমিশনারের অধীনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অ্যাডমিন বা ইকোনমিক ক্যাডারসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাইবার অপরাধ, পাসপোর্ট ও ভিসা ভেরিফিকেশনসহ বিভিন্ন সময় নানা জটিলতা ও আইনি সমস্যায় পড়েন। এক্ষেত্রে দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোতে পুলিশ সদস্যদের ডেপুটেশন রাখার দাবি পুরোনো।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও গত চার বছরে সেই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। হয়নি বিদেশ মিশন কিংবা দূতাবাসে পুলিশ কর্মকর্তা পদায়ন। দফায় দফায় পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হলেও রহস্যজনক কারণে তা আলোর মুখ দেখছে না।
 
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দূতাবাস বা মিশনগুলোতে সহকারী পুলিশ সুপার থেকে পুলিশ সুপার পদমর্যাদা পর্যন্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা যেতে পারে। যারা প্রবাসী বাংলাদেশিদের আইনি সহায়তা দেবেন। সেই দেশের পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন। পাসপোর্ট ও ভিসা ভেরিফিকেশনের কাজও দ্রুত করা সম্ভব হবে। কারণ, দেশে এসব কাজ করে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এছাড়া ইন্টারপোলের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করাও সহজ হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন।

পুলিশের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে বাহিনীটির সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে তাদের পুলিশ কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাদের নাগরিকদের সুরক্ষা এবং আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য তারা আমাদের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন। কারণ, একজন পুলিশ অন্য পুলিশের ভাষাটা খুব সহজে বোঝেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্যও নিজস্ব পুলিশ নিয়োগ করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলার পরও কেবল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও প্রফেশনাল জেলাসির কারণে মিশনগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদায়ন করা যাচ্ছে না। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা করে দ্রুতই এটা করা উচিত। এতে বাংলাদেশি প্রবাসীরাই বেশি উপকৃত হবেন।
 
ডিএমপি কমিশনার ও র‌্যাবের ডিজিসহ ১০টি পদ ‘গ্রেড–১’ করার দাবি

ডিএমপি কমিশনার ও র‌্যাব মহাপরিচালকসহ পুলিশ বাহিনীতে সচিব পদমর্যাদার ১০টি পদ ‘গ্রেড-১’ অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদকে চার তারকা জেনারেলের (সেনাপ্রধান) পদের সমান করার প্রস্তাব করা হয়।

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, আইজিপি সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার। তাকে আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাচিবিক ক্ষমতা দেওয়া হোক। এছাড়া পুলিশের পঞ্চম গ্রেডের যেসব কর্মকর্তা আছেন তাদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষমতা পুলিশ সদরদপ্তরকে দেওয়ার দাবি করা হয়।


 
এর বাইরে পুলিশ সদস্যদের খেলাধুলার জন্য স্বতন্ত্র স্পোর্টস ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও কমপ্লেক্স তৈরি, থানা পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক গাড়ি সরবরাহ, পর্যাপ্ত ফুয়েল সরবরাহ, পুলিশে কর্মরত সাধারণ কর্মীদের (সিভিল স্টাফ) আজীবন রেশন নিশ্চিত করা, পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুর পর তাদের পেনশন সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশ সদরদপ্তরের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি উত্থাপন করা হয় মতবিনিময় সভায়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি-দাওয়া ও সমস্যাগুলো শোনেন। কিছু দাবির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সভায় উপস্থিত সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট সচিবকে নির্দেশ দেন তিনি। কিছু বিষয় দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি।

সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এই রাজারবাগ মাঠে বলেছিলেন, তোমরা জনগণের পুলিশ হবে। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন আজ আপনারা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। আজ পুলিশ জনগণের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল ও আস্থায় পরিণত হয়েছে। আপনারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও জলদস্যু দমনে সাফল্য অর্জন করেছেন। বান্দরবানে বড় ধরনের জঙ্গি আস্তানায় সাহসিকতার সঙ্গে অভিযান চালিয়ে সফল হয়েছেন।’
 
জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান বলেন, পুলিশ কর্মকর্তারা পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে বেশকিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। সবগুলো প্রস্তাবই অত্যন্ত যৌক্তিক। পুলিশের কাজের ধরন অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, পুলিশের যতটুকু সার্ভিস দেওয়ার কথা, সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে আমরা সবটুকু সার্ভিস দেওয়ার চেষ্টা করেছি। করোনাভাইরাস মহামারির সময় পুলিশের প্রতিটি সদস্য জীবন বাজি রেখে সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত কাজ করেছেন।

‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে পুলিশ আছে জনতার পাশে’— এ প্রতিপাদ্যে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে গত ৩ জানুয়ারি শুরু হয় পুলিশ সপ্তাহ- ২০২৩। ওই দিন সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে বার্ষিক পুলিশ প্যারেডের মধ্য দিয়ে পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছয় দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য পুলিশ সপ্তাহ শেষ হয় গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় সভার মধ্য দিয়ে।

জেইউ/এমএআর/