বান্দরবানের আলীকদম এলাকার মো. করিম (২৮)। মাদকের মামলা আছে বলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। গ্রেপ্তারের সময় করিম এবং তার পরিবার পুলিশকে বারবার বলেছিলেন তিনি কোনোভাবেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। কিন্তু পুলিশ তাদের কথা শোনেনি। পরে বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। করিম নামে আরেক আসামির বদলে এই করিমকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর বাঁশখালী থানা পুলিশ ৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ জসিম উদ্দিন (২৬), মো. হারুন (২৭) ও মো. করিম (৩৫) নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করে পরদিন আসামিদের আদালতে পাঠানো হয়। সেই মামলায় তদন্ত করে আসামির নাম-ঠিকানা সঠিক আছে মর্মে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন বাঁশখালী থানার এসআই দীপক কুমার সিংহ।

কয়েকমাস জেল খাটার পর ২০২২ সালের ১৫ জুন তিন আসামির একজন করিমের জামিন হয়। জামিন পেয়ে তিনি পলাতক হয়ে যান। পরবর্তী হাজিরার দিন থেকে আদালতে অনুপস্থিত থাকেন করিম।

আরও পড়ুন :  পেশায় আইনজীবী, গাড়িতে লাগান পিবিআইয়ের স্টিকার!

পলাতক হওয়ায় একই বছরের ১ আগস্ট করিমের বিরুদ্ধে আবার ওয়ারেন্ট জারি করেন আদালত। সেই ওয়ারেন্টমূলে আলীকদম থানার একজন কর্মকর্তা ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অন্য এক করিমকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসেন। তাকে প্রাথমিকভাবে বান্দরবান কারাগারে রাখা হয়।

গ্রেপ্তারের পর নিরপরাধ করিমের পরিবার চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী মো. ওয়াহিদ ছায়েদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই আইনজীবী অপরাধ ছাড়াই করিমের কারাভোগ করার বিষয়টি আদালতকে অবহিত করেন। 

আদালত বিষয়টি শুনে ১৫ দিনের মাথায় ভুক্তভোগীকে জামিন দেন। একই সঙ্গে আগে গ্রেপ্তার হওয়া করিম এবং পরে গ্রেপ্তার হওয়া করিম এক কি না সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারকে তদন্তের আদেশ দেন।

আদালতের আদেশ পেয়ে সিনিয়র জেল সুপার মো. গিয়াস উদ্দিন গত বছরের ১২ নভেম্বর আদালতে দুই আসামির বিস্তারিত তথ্য ছবিসহ উপস্থাপন করেন। সার্বিক পর্যালোচনায় আদালতও নিশ্চিত হন দুই আসামি এক নন। আগে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি পরে গ্রেপ্তার হওয়া আসামির নাম-ঠিকানা ব্যবহার করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঠিকানা যাচাই না করে মনগড়া প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছেন। এর ফলে নিরপরাধ করিমকে ১৫ দিন কারাবাস করতে হয়।

এ বিষয়ে গত ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ এইচ এম শফিকুল ইসলামের আদালতে বিস্তারিত শুনানি হয়। শুনানি শেষে গত ২৯ জানুয়ারি তিনি একটি আদেশ দেন।

ওই আদেশে বলা হয়, ‘মামলাটি একটি মাদকের মামলা। এ ধরনের মামলায় জড়িতরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সঠিক নাম-ঠিকানা ব্যবহার করেন না। মামলার তদন্তের মাধ্যমে আসামিদের প্রকৃত নাম-ঠিকানা বেরিয়ে আসে। অত্র মামলার ক্ষেত্রে এ রকম একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া একজন মাদকের আসামি তার নিজের সঠিক তথ্য গোপন করে অন্য একজন নিরপরাধ ব্যক্তির নাম-ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। এর ফলে নিরপরাধ হয়েও একজনকে কারাবাস করতে হয়েছে। এতে ভুক্তভোগীর সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদাহানি হয়েছে। এর মাধ্যমে তার সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়েছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।’

আদেশে বলা হয়, ‌‘অভিযোগপত্রে পরিলক্ষিত হয় যে, অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা স্থানীয়ভাবে আসামি করিমের নাম-ঠিকানা যাচাই করে মন্তব্য প্রদান করেছেন যে, আসামির নাম-ঠিকানা তিনি সঠিক পেয়েছেন এবং আসামির বর্ণিত ঠিকানায় কম-বেশি ১০ বছর যাবত বসবাস করছেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, স্থানীয় তদন্তে আসামির স্বভাব-চরিত্র খারাপ মর্মে তিনি জানতে পেরেছেন। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তার এসব মন্তব্যের কোনোটিই সঠিক নয়। তিনি মূলত আসামিদের নাম-ঠিকানা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করেই মনগড়া মন্তব্য লিখেছেন এবং প্রকৃত আসামি গ্রেপ্তারের সময় যে ভুল নাম-ঠিকানা বলেছেন উক্ত ঠিকানাই সঠিক মর্মে উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা হয় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি কর্তৃক অন্যায়ভাবে লাভবান হয়ে সঠিক তদন্ত করা থেকে বিরত থেকেছেন অথবা তিনি সম্পূর্ণরূপে একজন অদক্ষ কর্মকর্তা।’

আদেশে আরও বলা হয়, ‘ঘটনা মোতাবেক এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলা। মাদকের অনাকাঙ্ক্ষিত কালো থাবা আমাদের পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এমন একটি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা তার যে অদক্ষতা কিংবা অসততার পরিচয় দিয়েছেন তা কোনো অবস্থাতেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তার অদক্ষতা কিংবা অসততার কারণে একজন নিরপরাধ সাধারণ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। যার কৈফিয়ত প্রদানে তদন্তকারী কর্মকর্তা বাধ্য।’

আদেশে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট সহকারী পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং অভিযুক্ত তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী করিমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. ওয়াহিদ ছায়েদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো অপরাধ ছাড়াই আমার মক্কেল ১৫ দিন জেল খেটেছেন। তার এই ক্ষতি অপূরণীয়। আমি এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং আসামির ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বাঁশখালী থানার সাবেক এসআই বর্তমানে সীতাকুণ্ড থানায় কর্মরত দীপক কুমার সিংহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি গ্রেপ্তারের সময় করিমের দেওয়া ঠিকানা যাচাই করতে আলীকদম থানায় একটি অনুসন্ধানী স্লিপ পাঠাই। এটি তদন্ত করেন ওই থানায় কর্মরত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) জসিম উদ্দিন। তিনি আসামির নাম-ঠিকানা সঠিক আছে মর্মে প্রতিবেদন দিয়েছেন। তার ভিত্তিতেই আমি আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছি।

আদালতের আদেশে বলা হয়, তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামির নাম-ঠিকানা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করেই মনগড়া মন্তব্য লিখেছেন এবং প্রকৃত আসামি যে ভুল নাম-ঠিকানা বলেছেন উক্ত ঠিকানাই সঠিক মর্মে উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা হয় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি কর্তৃক অন্যায়ভাবে লাভবান হয়ে সঠিক তদন্ত করা থেকে বিরত থেকেছেন অথবা তিনি সম্পূর্ণরূপে একজন অদক্ষ কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে অনুসন্ধানী স্লিপের সূত্রে ঠিকানা যাচাইকারী তদন্ত কর্মকর্তা ও বর্তমানে বান্দরবানের রুমা থানায় কর্মরত এএসআই জসিম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আসামির বাড়িতে গিয়েছি। তিনি শ্রমিকের কাজ করেন বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। তার বাবা মার সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, কোনো লোক হয়তো ফুঁসলিয়ে তাকে ধরিয়ে দিয়েছেন। আমি আসামির সঙ্গেও মোবাইলে কথা বলেছি।

‘ওই সময় করিম নামের প্রকৃত আসামি তো জেলে ছিলেন’- এই প্রতিবেদক তা জানালে এএসআই জসিম বলেন, আমি জেলে থাকার বিষয়টি জানতাম না! আপনি এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন।

অর্থাৎ তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতেনই না তিনি একজন আটক থাকা আসামির ঠিকানা যাচাই করছেন! না জেনেই ভুল প্রতিবেদন দিয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী মো. করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ যখন প্রথমে আমার বাড়িতে যায় তখন আমি থানচিতে ছিলাম। আমি পাথর ভাঙার মেশিন চালাই। আমার পরিবারের সবাই পুলিশকে অনেক বার বলেছে, আমি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। এরপরও দ্বিতীয়বার পুলিশ এসে বাড়ি থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করে। তখন এলাকার সবাইও বলেছেন আমি এসব করি না। কিন্তু পুলিশ কারো কথা শোনেনি। আমি অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি এবং সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।

এমআর/এসকেডি/জেএস