ইরানে গত চার মাসের অধিক সময় ধরে চলমান গণআন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করেছে ৩৫ বাংলাদেশি নাগরিক। সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করেন তারা।

এতে বলা হয়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণী জিনা মাহসা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে হিজাববিরোধী বিক্ষোভ দ্রুত প্রবর্তিত হয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে। সেখানে তারা স্লোগানে বলে যেই সরকার বাচ্চাদের হত্যা করে, আমরা সেই সরকার চাই না।

সমগ্র ইরানে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া নারীমুক্তি ও সরকারবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে ইতোমধ্যে পাঁচশতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যাদের মধ্যে অন্তত ৫৭ জন শিশু। ১৯ হাজারেরও বেশি আন্দোলনকারীকে কারাবন্দি করা হয়েছে। এই চলমান আন্দোলন যেন গণঅভ্যুত্থান ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত না হয়, সেজন্য ইরানের শাসকগোষ্ঠী ভয়ঙ্কর জুলুম নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে: গণগ্রেপ্তার, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রতিবাদকারীদের হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা, বিচারের ছলনা, টর্চার, নারী আন্দোলনকারীদের যৌন টর্চার (ধর্ষণ), মৃত্যুদণ্ড প্রদান, একের পর এক আন্দোলনকারী বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা (মোহাম্মদ মাহদি কারামি, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেইনি, মোহসেন শেকারি, মাজিদরেজা রাহনাভার্দ), প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করা।  ইতোমধ্যে আরো ১৭ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, বডিবিল্ডার, র‍্যাপ সঙ্গীতশিল্পী ও নাপিত।

গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে আমরা জানতে পেরেছি যে, শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইরানের জনগণের ক্ষোভে ফুঁসে ওঠার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে ধর্মীয় এলিটদের রাজনৈতিক সুযোগসুবিধা কুক্ষিগত করা, নিজেদের জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে মনে করা, সাধারণ মানুষের সামাজিক জীবনকে দমনপীড়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা, দুর্নীতি, প্যানডামিকের অব্যবস্থাপনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাপক বেকারত্ব বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, ধর্মকে এক্সপ্লইট করে শাসন পাকাপোক্ত করা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বাসিজকে লেলিয়ে দেয়া। পশ্চিমের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যেমন ইরানের অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে এ কথা সত্য, একই সঙ্গে ১৯৭৯ এর ইসলামী বিপ্লবের পর সরকার-প্রবর্তিত ভর্তুকি ও কল্যাণমূলক উদ্যোগ প্রত্যাহার জনমানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

আমরা অবিলম্বে ইরানের জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর চলমান সব রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন বন্ধের দাবি জানাচ্ছি এবং আন্দোলনকারী সব কারাবন্দির মুক্তি দাবি করছি। একই সঙ্গে ইরানের জনগণের চলমান আন্দোলনে সক্রিয় সমর্থন প্রদান ও রাজপথে সংহতি আন্দোলন গড়ে তুলতে আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানুষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হচ্ছেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গীতি আরা নাসরিন, রাজনীতিবিদ মোশরেফা মিশু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, আদিবাসী অধিকার সুরক্ষাকর্মী ও চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা রাণী য়েন য়েন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অ্যাপিলেট ডিভিশনের অ্যাডভোকেট আইনুন্নাহার সিদ্দিকা লিপি, জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নাজনীন শিফা, নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক ড. নাসরিন খন্দকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক শিল্পী বড়ুয়া, নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. নাসরিন সিরাজ, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার, শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নি শিখা জামালী, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি শম্পা বসু, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী সায়েমা খাতুন, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক বীথি ঘোষ, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. সাদাফ নূর, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক হানা শামস আহমেদ, নারী অধিকারের সভানেত্রী লায়লা পারভীন, লেখক তাহেরা বেগম জলি, নারী সংহতির সভাপতি শ্যামলী শীল, লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী সুতপা বেদজ্ঞ, অ্যাক্টিভিস্ট ইলিরা দেওয়ান, মানবাধিকারকর্মী রোজিনা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মার্জিয়া রহমান, দিপ্তী দত্ত, সাংবাদিক ও গবেষক ড. সায়দিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক মন্টি বৈষ্ণব, গার্মেন্ট শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনা আক্তার, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য আশরাফী নিতু, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ এবং রাজনৈতিক কর্মী জলি তালুকদার।

/এমএইচএন/এমএ