দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। জেলার পাঁচ উপজেলা শহর কিংবা গ্রামের কাঁচা-পাকা সড়কে দিন দিন বাড়ছে বিভিন্ন অবৈধ যানবাহন চলাচল। আর এসব যানবাহন চলাচলের ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়কে ঝরছে তাজা প্রাণ। গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে স্বপ্ন ভাঙছে মানুষের। বাদ পড়ছে না শিশু-বৃদ্ধও। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে পঙ্গু হয়ে হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। 

সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, পঞ্চগড়ে সবেচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা সড়কে। এ জেলায় মহাসড়ক ছাড়া ভারি যানবাহন চলাচলের জন্য বিকল্প সড়ক না থাকায় ছোট বড় সব যানবাহন চলে এই সড়কে। আর এ কারণে দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে পঞ্চগড় মহাসড়কে। দুর্ঘটনায় আহত-নিহত বা পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবন-যাপন করছে অনেক পরিবার। 

হাসিনা বেগম

জানা যায়, জেলার সদর, আটেয়ারী, তেঁতুলিয়া, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ। আহত হয়েছে আরও পাঁচ শতাধিক। তবে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে ট্রাক, ট্রাক্টর, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেলে। 

এ সকল সড়ক দুর্ঘটনায় হাতে গোনা দুটি একটি মামলা হলেও বেশির ভাগই টাকা দিয়ে সমাধান করা হয়েছে। ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় জীবনের দরদাম করা হয়ে থাকে। তারপর ছেড়ে দেওয়া হয় ঘাতক গাড়িসহ চালকদের। দুর্ঘটনায় আহতদের প্রথমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও সামান্য কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে তারা। এতে চালকরা ছাড়া পেয়ে আবার ঘটায় দুর্ঘটনা। আর এভাবেই পঞ্চগড় সড়কে নিভে যাচ্ছে মানুষের জীবন প্রদীপ। 

জেলার সব থেকে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা তেঁতুলিয়া ও সদর উপজেলা। এখানে অবৈধভাবে ট্রাক্টর ও ইজিবাইক চলাচল করছে। বেশিরভাগ চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। বদলি চালক হিসেবে গাড়ি চালান তারা। বিশেষ করে সড়কে যেসকল মোটরসাইকেল চলছে তার ৬০ শতাংশ চালকদের লাইসেন্স নেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মনিটরিং কিংবা ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেও বাস্তবে দেখা যায় উল্টো চিত্র। 

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাদের সুখের সংসারে নেমে এসেছে কালো ছায়া। থমকে গেছে তাদের আনন্দময় জীবনের গতি। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে তেমন কোনো সাহায্য ও সহযোগিতা পায়নি তারা। ফলে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের। 

এ বিষয়ে কথা হয় তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের লতিফগছ এলাকার বাসিন্দা হাসিনা বেগমের সঙ্গে ৷ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে অনাহারে দিন কাটছে তার। তিনি বলেন, আমার ছেলে আবু হাসান  ৬ মাস হলো মারা গেছে। পাথর ভাঙা মেশিনে কাজ করত সে। ছেলের আয় দিয়েই আমাদের সংসারটা ভালোই চলত। 

বৃদ্ধা খাইরুন নেছা

কাজে যাওয়ার পথে সড়কে হানিফ পরিবহনের একটি বাস আমার ছেলেকে ধাক্কা দিলে সে আহত হয়। দুই বছর  চিকিৎসা করার পর ৬ মাস আগে মারা গেছে। ছেলেকে হারিয়ে পাগল হয়ে গেছি আমি। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমি চাই না আমার মতো আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক। 

একই কথা জানান সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়ন যতনপুকুরী এলাকার বাসিন্দা তাহেরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার তিন বছরের ছেলে তানভির ৩ মার্চ সকালে ট্রাক্টরের চাপায় মারা যায়। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, যানবাহনের চালকদের যেন প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়।

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ছেলেকে নিয়ে কষ্টে দিন কাটানো জেলার সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের বামনপাড়া এলাকার বৃদ্ধা খাইরুন নেছা বলেন, আমার ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এক বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছি না। সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পাইনি। বিচারও পেলাম না। 

এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন সহায়তা ফাউন্ডেশন (আসফ) জেলা শাখার সভাপতি আব্দুস সাত্তার জানান, পঞ্চগড়ে দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক মানুষ আহত-নিহত ও পঙ্গুত্ববরণ করছে। মানবেতর জীবনযাপন করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। তাদের তেমন কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না। ঘাতক চালকদের প্রশিক্ষণ ও বিচারের আওতায় আনা হয় না। এসব বিষয়ে যদি গুরুত্ব দেওয়া হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা কমে যাবে। 

এদিকে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর পঞ্চগড় জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম জানান, ইদানিং পঞ্চগড়ে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ও সড়কের দুই পাশে বালু, পাথর রাখার কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। যারা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে তারা কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছে না। প্রশাসন যদি চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত তাহলে পঞ্চগড় মহাসড়ক একদিন নিরাপদ সড়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।

এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরেফে রব্বানী জানান, পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা রুটে মোট ৫১ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। তবে আমরা দুর্ঘটনারোধে হাইওয়ে থানার সকল সদস্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। 

অবৈধভাবে চলাচলকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে, বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ফলে বিগত দিনের তুলনায় দুর্ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া আমরা গাড়ির গতি নির্ণয় করছি এবং মহাসড়কে যেন কোনো গাড়ি পার্কিং না করে সেক্ষেত্রে কাজ করছি।   

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা জানান, উপজেলা প্রশাসনের উদ্যােগে আমরা সড়ক দুর্ঘটনারোধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। আমরা গাড়ির লাইসেন্স দেখছি এবং যে সকল চালকের লাইসেন্স নেই তাদের শাস্তি আওতায় নিয়ে আসছি। চেষ্টা করছি তেঁতুলিয়ায় লাইসেন্সের জন্য একটি ক্যাম্প করা যায় কিনা। পাশাপাশি হাইওয়ে থানা সার্বক্ষণিক সড়ক দুর্ঘটনারোধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করি দ্রুত  সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পারব।

এমআইএইচ/এসপি