অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নেওয়ার জন্য দেওয়া হচ্ছে ঘুষ

গাজীপুরের শ্রীপুরের বাসিন্দা মোছা. খাদিজা খাতুন (৩৮)। গত ২ মার্চ সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যাওয়া ছেলে আরমানকে (১৫) নিয়ে এসেছেন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)। ছেলের ডান পায়ের কয়েক জায়গার হাড় ভেঙে যাওয়ায় ৩ মার্চ অস্ত্রোপচার করে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে মোট ১২ দিন। তখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিক থাকলেও বিপত্তি ঘটে হাসপাতাল ছাড়ার দিন। অসুস্থ ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যেতে পাচ্ছেন না, কারণ অ্যাম্বুলেন্স!

তবে হাসপাতালের বাইরে ও ভেতরে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো অ্যাম্বুলেন্স। শ্রীপুর যেতে খাদিজা খাতুনের কাছে দাম হাঁকাচ্ছেন সাধারণ ভাড়ার কয়েকগুণ বেশি। আর বাইরের অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনলে ‘রোগী নিয়ে যেতে দেবে না’ বলে হুমকি দিচ্ছেন সেখানকার চালকরা।

অ্যাম্বুলেন্স খোঁজার এক ফাঁকে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় খাদিজা খাতুনের। অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ছেলেকে যেদিন শ্রীপুর থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম তখন ভাড়া দিয়েছি দুই হাজার ৮০০ টাকা। কিন্তু এখন হাসপাতালের সামনে থাকা অ্যাম্বুলেন্সচালকরা চাচ্ছেন সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এমনকি তাদের ছাড়া অন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স ডেকে এনেও যেতে পারব না বলে হুমকি দিচ্ছে। এ নিয়ে হাসপাতালের লোকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, এখানে নাকি এটাই নিয়ম। ছেলেকে নিয়ে প্রায় ১৩ দিন ছিলাম। অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন এত টাকা ভাড়া কীভাবে দেব?’

নিটোরে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু খাদিজা খাতুন নন, প্রতিদিনই এমন সমস্যায় পড়তে হয় হাসপাতালছাড়া রোগীদের। নিটোরে একটি অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের ছাড়া অন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে এখান থেকে রোগী নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। আর এসব অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে যেতে হলে গুণতে হয় ‘অস্বাভাবিক ভাড়া’।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, নিটোরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তাদের একটি অংশ স্থানীয় কয়েকজন অ্যাম্বুলেন্স মালিকের সঙ্গে যোগসাজশে এ সিন্ডিকেট চালায়। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে রোগী নিটোরে আসতে পারলেও যাওয়ার সময় যেতে হয় সিন্ডিকেটের অ্যাম্বুলেন্স দিয়েই।

যেসব রোগী বা তাদের স্বজনরা সিন্ডিকেটের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে যেতে চান না, তাদের পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। এছাড়া বাইরের যেসব অ্যাম্বুলেন্স নিটোরে রোগী নামিয়ে দিতে ও নিতে আসেন তাদেরও নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা দিতে হয় সিন্ডিকেটকে। সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকে এ টাকাগুলো কালেকশন করেন দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা।

সাভার থেকে দুই হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে বড় ভাই ফারুক মিয়াকে নিটোরে নিয়ে এসেছিলেন সজীব। এখন তিনি সাভার যাওয়ার জন্য আড়াই হাজার টাকা দিয়েও অ্যাম্বুলেন্স পাচ্ছেন না। এদিকে সিন্ডিকেটের চালকরা ভাড়া চাচ্ছেন তিন হাজার টাকা। যা স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে এক হাজার টাকা বেশি।

এ বিষয়ে সজীব বলেন, ভাইয়ের মেরুদণ্ডের অপারেশন হয়েছিল। আজ তিনি রিলিজ পেয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাব কিন্তু এখানে সিন্ডিকেট ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা যায় না। বিষয়টি নিয়ে কর্তব্যরত কয়েকজন আনসার সদস্যকে অভিযোগ করলে তারা উল্টো বলেন, ‘আমাদের পরিচিত অ্যাম্বুলেন্স আছে, কিন্তু ভাড়া দিতে হবে তিন হাজার টাকা’। তখন বুঝতে পারলাম তারাও এই সিন্ডিকেটের সদস্য। এখন হয়তো বাধ্য হয়ে বেশি টাকা দিয়েই যেতে হবে। কারণ বাইরের অ্যাম্বুলেন্স তো তারা ভেতরে ঢুকাতে দেবে না। আর রোগীকে নিয়ে বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করাও সম্ভব না।

এদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে আসা অ্যাম্বুলেন্সচালকরা অভিযোগ করে বলেন, রোগী নিয়ে এখানে আসলেই টাকা দিতে হচ্ছে আনসার সদস্যদের। আবার রোগীকে নিয়ে ফিরে যেতে হলেও দিতে হচ্ছে আরও বেশি টাকা।

মানিকগঞ্জ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায় আসা-যাওয়ার চুক্তিতে নিটোরে এক রোগীকে নিয়ে আসেন অ্যাম্বুলেন্সচালক জাহিদ মিয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রোগী নামিয়ে দেওয়ার পরপরই একজন আনসার সদস্য আমাকে এসে বলেন, রোগীকে নিয়ে আবার ফিরে যাব কি না। উত্তরে তাকে বললাম বিকেলের দিকে রোগীকে নিয়ে আবার ফিরে যাব। তখন সে আমাকে বলে অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের ভেতরে রাখতে হলে ৫০০ টাকা দিতে হবে। না হলে বের করে দেবে, রোগী নিয়ে যেতে দেবে না। এটা নাকি স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্সগুলোর দাঁড়ানোর জায়গা। পরে জোরাজুরি করে তাকে ৩০০ টাকা দিয়ে দাঁড়াবার অনুমতি পাই।’

জাহিদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কারণ সম্পর্কে ওই আনসার সদস্যের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান।

অন্যদিকে, সিন্ডিকেটভুক্ত অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা বলছেন, হাসপাতালের লোকজনকে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা দিতে হয় বলে তাদের বেশি ভাড়া হাঁকাতে হচ্ছে। নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা না দিলে তারাও এখান থেকে রোগী আনা-নেওয়া করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিন্ডিকেটের এক অ্যাম্বুলেন্সচালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের মধ্যে কিছু চালককে দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে হাসপাতালের লোকজনকে টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে তারা এখান থেকে রোগী নিতে দেয় না। তাদের টাকা দেই বলে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ভাড়া নিতে হয়।

বাইরের কাউকে কেন রোগী নিতে দেওয়া হয় না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা যদি বাইরে থেকে এসে কম টাকায় রোগী নিয়ে যায়, তাহলে তো আমরা সমস্যায় পড়ব। অনেক টাকা দিয়ে গাড়ি নিয়ে এখানে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়। তাই বাইরের চালকদের সুযোগ দেওয়া হয় না।

সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল গণি মোল্লার অফিস কক্ষের সামনে অপেক্ষা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইলে একাধিকবার কলের পাশাপাশি খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি।

আব্দুল গণির কর্মচারী মোহাম্মদ কালাম জানান, তিনি এখনও অফিসে আসেননি। এছাড়া হাসপাতালটির উপ-পরিচালক অসুস্থ থাকায় ছুটিতে আছেন বলে জানা গেছে।

এমএসি/এমএইচএস/এমএআর/