পুলিশ হেফাজতে মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ও এসআই আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে একই থানায় মামলা হয়েছে। সেই মামলা তদন্ত করছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) শাহনেওয়াজ খালেদ। আদালত বলেছিলেন, অভিযুক্ত ওসি ও এসআইয়ের কাছ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে শোকজের জবাব নিয়ে জমা দিতে। কিন্তু সিআইডির এসপি দুজনের পক্ষে বর্তমান ওসির দায়িত্ব পালন করা পরিদর্শক সাদেকুর রহমান থেকে শোকজের জবাব নিয়ে আদালতে জমা দিয়েছেন।

বিষয়টি বিধিবহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। এ বিষয়ে সোমবার (২৭ মার্চ) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেছার আদালত একটি আদেশ দিয়েছেন। 

আদেশে বলা হয়- অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে। ভুক্তভোগীকে ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়েছে ও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে অভিযুক্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তা ছুটি থাকায় তাদের পক্ষে বর্তমান দায়িত্ব পালন করা ওসি শোকজের জবাব দিয়েছেন। যদিও আদেশ দেওয়া হয়েছিল দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে শোকজের জবাব দিতে। আদেশটি সিআইডি এসপি রিসিভও করেছিলেন। কিন্তু তিনি অভিযুক্তদের পক্ষে ওসির কাছ থেকে জবাব নিয়েছেন। যেটি বিধিবহির্ভূত। আদালত আদেশ পালনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডি এসপিকে আরও সতর্ক হতে নির্দেশ দেওয়া হল। একই সঙ্গে অভিযুক্ত ওসি-এসআই থেকে শোকজের জবাব নিয়ে দ্রুত আদালতে জমা দিতে বলা হয়।

এ বিষয়ে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মওলা মুরাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিআইডি এসপিকে বলা হয়েছিল অভিযুক্ত ওসি নাজিম উদ্দিন ও এসআই আবদুল আজিজের কাছ থেকে শোকজের জবাব নিতে। কিন্তু আদালতের আদেশ না মেনে তিনি বর্তমানে দায়িত্ব পালন করা ওসি থেকে শোকজের জবাব নিয়ে আদালতে জমা দিয়েছেন। কিন্তু আদালত সেটি গ্রহণ করেননি এবং এটি বিধিবহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছেন।

আদালত সূত্র জানায়, পুলিশ হেফাজতে মারধরের অভিযোগে ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেছার আদালতে একটি পিটিশন মামলা দায়ের করেন চমেক হাসপাতালের আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার সৈয়দ মোহাম্মদ মুনতাকিম ওরফে মোস্তাকিম। একই পিটিশনে আসামি করা হয় এসআই আবদুল আজিজকে। আদালত পিটিশনটিকে নিয়মিত মামলা হিসেবে পাঁচলাইশ থানায় রেকর্ডের আদেশ দেন। একই সঙ্গে মামলাটি পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা দিয়ে সিআইডিকে তদন্তের আদেশ দেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মোস্তাকিম তার মাকে ৭ বছর ধরে ডায়ালাইসিস করান। সম্প্রতি ডায়ালাইসিস মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তিনিসহ রোগীর স্বজনরা মিলে আন্দোলন করেন। ঘটনার দিন ১০ জানুয়ারি তারা চমেক হাসপাতালের প্রধান গেটে জড়ো হয়ে মানববন্ধন করেন। পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সেখানে এসে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে ওসি নাজিম মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিচে মারধর করেন এরপর তাকে থানায় নিয়ে পুনরায় মারধর করেন। 

মারধরের সময় এসআই আবদুল আজিজ মোস্তাকিমকে বলেন ‌‘ওসি নাজিম স্যারের সাথে আর বেয়াদবি করবি?’। এ সময় ওসি নাজিম বলে ‘শালারে রিমান্ডে এনে থানায় পেটাতে হবে, তারপর বুঝবি পুলিশ কি জিনিস?’। এরপর থানায় মারধরের বিষয়টি ফাঁস করলে মোস্তাকিমকে ক্রসফায়ার দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি পাঁচলাইশ থানায় নিয়মিত মামলা হয়। নিজের থানায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি হন ওসি নাজিম উদ্দিন ও এসআই আবদুল আজিজ। তবে মামলা দায়েরের আগের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটিতে যান দুজনই। এরপর থেকে তারা দুজনেই আর কর্মস্থলে আসেননি।

আইনজীবীরা বলেছেন, থানায় মামলা দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে হয়। অথবা আসামিকে স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হয়। আসামি যদি সরকারি কর্মকর্তা হন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হয়। তবে ওসি নাজিম ও এসআই আজিজকে গ্রেপ্তার করেনি মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তারা কেউ আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি এবং কাউকে বরখাস্তও করা হয়নি। দুজন ছুটির অজুহাতে আর থানায় আসেননি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়ম হচ্ছে থানায় মামলা রেকর্ডের সঙ্গে সঙ্গে আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় ওসি নাজিম ও এসআই আজিজকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। আইন অনুযায়ী তারা এখন পলাতক রয়েছেন। যতটুকু শুনেছি তারা ছুটিতে রয়েছেন। তারা যোগ দিতে এলেই গ্রেপ্তার করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। যদি না করেন তাহলে বেআইনি কাজ হবে।

উল্লেখ্য, ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২০২৩ সালের শুরুতে চমেক হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনরা আন্দোলনে নামেন। কয়েকদিন ধরে চলা এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১০ জানুয়ারি বিক্ষোভকারীরা চমেকের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। এ দিন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আন্দোলনকারীদের সড়ক ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সড়ক না ছাড়ার ঘোষণা দেন। বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি নিজের মুঠোফোন বের করে বিক্ষোভকারীদের ভিডিও ধারণ করেন এবং তাদের পরে দেখে নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন। এরপর একযোগে সবাই ওসির বিরুদ্ধে হইচই শুরু করেন এবং ভিডিও ডিলিট করার দাবি জানান।

চমেক হাসপাতালে কিডনি রোগীদের স্বজনদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। এদিন ওসির মারমুখী আচরণের ফুটেজ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। মানবিক এ আন্দোলন থেকে একজনকে মারতে মারতে গ্রেপ্তার করেন ওসি নাজিম। গ্রেপ্তার মোস্তাকিমও ওসির সেই মোবাইল সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে হাতাহাতিতে ওসির মোবাইল মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। এরপর ওসি মোস্তাকিমকে পেটাতে পেটাতে চমেকের প্রধান ফটকের বিপরীতে এপিক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেও তাকে আরেক দফা মারধর করা হয়। কিছুক্ষণ পর এপিকের সামনে থেকে আরও একজনকে ওসি ধরে ভেতরে নিয়ে যান। পাশাপাশি অন্য পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেন।

একপর্যায়ে একজনকে ছেড়ে দিলেও মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর ওই দিন রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় মোস্তাকিমকে। এছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। এতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও কর্তব্য কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মোস্তাকিমকে ১১ জানুয়ারি আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এরপর ১৫ জানুয়ারি তাকে জামিন দেন আদালত। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন মোস্তাকিম।

এমআর/ওএফ