পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের দায়ে আদালতের আদেশে নিজ থানায় মামলার আসামি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল আজিজ। মামলা দায়েরের আদেশ দেওয়ার পরপরই দুজন হঠাৎ অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটি নেন। এরপর ৭৮ দিন পেরিয়ে গেলেও দুজন আর থানায় আসেননি। 

তবে এতদিন ধরে দুজনের একসঙ্গে অসুস্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে চট্টগ্রাম পুলিশের ভেতরেই। দুজনেই দীর্ঘ দিন ধরে অনুপস্থিত থাকলেও তারা তাদের অসুস্থতা ও চিকিৎসার বিষয়ে কোনো কিছুই জানাননি। এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্রও জমা দেননি। তবে সম্প্রতি ওসি ও এসআই নগর পুলিশ উত্তর জোন কার্যালয়ে চিকিৎসার কাগজ জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন উপ-কমিশনার মোখলেছুর রহমান।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুজন চার দিনের ছুটি নিয়েছিলেন। পরে অসুস্থতার কারণে তারা ৭৮ দিন ধরে থানায় অনুপস্থিত। সম্প্রতি দুজনেই চিকিৎসার কাগজ জমা দিয়েছেন। ওসি নাজিমের জ্বর-সর্দি রয়েছে। তার ফুসফুসেও কিছু সমস্যা হয়েছে বলে কাগজ থেকে জানা গেছে। 

তবে এসআই আজিজের কী অসুখ হয়েছে তা মনে নেই বলে জানান তিনি।

আলোচিত এ মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটির চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ইউনিটের এসপি শাহনেওয়াজ খালেদ নিজেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত তাকে বলেছিলেন অভিযুক্ত ওসি ও এসআই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে শোকজের জবাব নিয়ে জমা দিতে। কিন্তু দুজনের পক্ষে বর্তমান ওসির দায়িত্ব পালন করা পরিদর্শক সাদেকুর রহমান থেকে শোকজের জবাব নিয়ে আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে সেই জবাব আদালত গ্রহণ করেননি। পুনরায় দুজনের কাছ থেকে জবাব নিয়ে আদালতে জমা দিতে নির্দেশ দেন বিচারক।

জানতে চাইলে এসপি শাহনেওয়াজ খালেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ মে মামলার সবশেষ ধার্য তারিখ গেছে। ওই দিন পর্যন্ত দুজনের কেউ শোকজের জবাব দেননি। তাদের কাউকে গ্রেপ্তার বা কেউ আদালত থেকে জামিনও নেননি। হয়তো তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছেন। 

তিনি বলেন, কারাগার থেকে বেরিয়ে ভুক্তভোগী মোস্তাকিম চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে যে চিকিৎসা নিয়েছেন, সেখানকার সনদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। এ হিসেবে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সুযোগ নেই। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেও আমরা নারাজি দেব। যেহেতু মামলাটি একজন এসপি তদন্ত করছেন, সেহেতু সুষ্ঠু তদন্তের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।

আদালত সূত্র জানায়, পুলিশ হেফাজতে মারধরের অভিযোগে ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেছার আদালতে একটি পিটিশন মামলা দায়ের করেন চমেক হাসপাতালের আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার সৈয়দ মোহাম্মদ মুনতাকিম ওরফে মোস্তাকিম। একই পিটিশনে আসামি করা হয় এসআই আবদুল আজিজকে। আদালত পিটিশনটিকে নিয়মিত মামলা হিসেবে পাঁচলাইশ থানায় রেকর্ডের আদেশ দেন। একই সঙ্গে মামলাটি এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা দিয়ে সিআইডিকে তদন্তের আদেশ দেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মোস্তাকিম তার মাকে ৭ বছর ধরে ডায়ালাইসিস করান। ডায়ালাইসিস মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তিনিসহ রোগীর স্বজনরা মিলে আন্দোলন করেন। ঘটনার দিন ১০ জানুয়ারি তারা চমেক হাসপাতালের প্রধান গেটে জড়ো হয়ে মানববন্ধন করেন। পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সেখানে এসে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে ওসি নাজিম মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিচে মারধর করেন এরপর তাকে থানায় নিয়ে পুনরায় মারধর করেন। মারধরের সময় এসআই আজিজ মোস্তাকিমকে বলেন ‌‘ওসি নাজিম স্যারের সাথে আর বেয়াদবি করবি?’। এ সময় ওসি নাজিম বলে ‘শালারে রিমান্ডে এনে থানায় পেটাতে হবে, তারপর বুঝবি পুলিশ কি জিনিস?’। এরপর থানায় মারধরের বিষয়টি ফাঁস করলে মোস্তাকিমকে ক্রসফায়ার দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি পাঁচলাইশ থানায় নিয়মিত মামলা হয়। নিজের থানায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি হন ওসি নাজিম উদ্দিন ও এসআই আবদুল আজিজ। তবে মামলা দায়েরের আগের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটিতে যান দুজনই। এরপর থেকে তারা দুজনেই আর কর্মস্থলে আসেননি।

আইনজীবীরা বলেছেন, থানায় মামলা দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত আসামিদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অথবা আসামি স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আবার আসামি যদি সরকারি কর্মকর্তা হন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার রীতি রয়েছে। তবে ওসি নাজিম ও এসআই আজিজকে গ্রেপ্তার করেনি সিআইডি। তারা কেউ আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি এবং কাউকে বরখাস্তও করা হয়নি। মামলার আদেশের পর থেকে দুজন ছুটির অজুহাতে আর থানায় আসেননি।

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১১ মে) চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলোচিত মামলাটিতে পাঁচলাইশ থানার ওসি-এসআই কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। কেউ আদালত থেকে জামিনও নেননি।

উল্লেখ্য, ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২০২৩ সালের শুরুতে চমেক হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনরা আন্দোলনে নামেন। কয়েকদিন ধরে চলা এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১০ জানুয়ারি বিক্ষোভকারীরা চমেকের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। এ দিন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আন্দোলনকারীদের সড়ক ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সড়ক না ছাড়ার ঘোষণা দেন। বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি নিজের মুঠোফোন বের করে বিক্ষোভকারীদের ভিডিও ধারণ করেন এবং তাদের পরে দেখে নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন। এরপর একযোগে সবাই ওসির বিরুদ্ধে হইচই শুরু করেন এবং ভিডিও ডিলিট করার দাবি জানান।

চমেক হাসপাতালে কিডনি রোগীদের স্বজনদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। এদিন ওসির মারমুখী আচরণের ফুটেজ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। মানবিক এ আন্দোলন থেকে একজনকে মারতে মারতে গ্রেপ্তার করেন ওসি নাজিম গ্রেপ্তার মোস্তাকিমও ওসির সেই মোবাইল সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে হাতাহাতিতে ওসির মোবাইল মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। এরপর ওসি মোস্তাকিমকে পেটাতে পেটাতে চমেকের প্রধান ফটকের বিপরীতে এপিক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেও তাকে আরেক দফা মারধর করা হয়। কিছুক্ষণ পর এপিকের সামনে থেকে আরও একজনকে ওসি ধরে ভেতরে নিয়ে যান। পাশাপাশি অন্য পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেন।

একপর্যায়ে একজনকে ছেড়ে দিলেও মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর ওই দিন রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় মোস্তাকিমকে। এছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। এতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও কর্তব্য কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মোস্তাকিমকে ১১ জানুয়ারি আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এরপর ১৫ জানুয়ারি তাকে জামিন দেন আদালত। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন মোস্তাকিম।

এমআর/ওএফ