চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী ঘাট জেলে পাড়ায় সমুদ্রের কয়েকফুট দূরত্বেই থাকেন মো. বেলাল। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে পরিবার নিয়ে এখানের বসবাস তার। এখানেই একটি চায়ের দোকান ও ভাতঘর চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ঘূর্ণিঝড় এলেই আশ্রয় নেন বাড়ি থেকে আরও কয়েকগজ দূরে আউটার রিং রোডের পাশে। এখানে ত্রিপল দিয়ে ছোট তাবু করেছেন তিনি। এটিকেই নিরাপদবোধ করেন।

তার মতে, রিং রোডের উচ্চতা অনেক বেশি, প্রায় দুই তলা বিল্ডিংয়ের সমান। এই বেড়িবাঁধ ডোবা মানে আশ্রয়কেন্দ্রও ডুবে যাবে। এই বিশ্বাস থেকে তিনি ঘূর্ণিঝড় হলেও বেড়িবাঁধ ছেড়ে যান না।

বেলাল ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদককে বলেন, তার গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপ উপজেলার পৌরসভা ৯ নম্বর এলাকায়। সেখানে ভাঙনের কারণে আশ্রয় নেন আকমল আলী ঘাট জেলে পাড়ায়। এটিই তার এখন স্থায়ী নিবাস। যদিও নিজস্ব জমিতে বাড়িঘর করতে পারেননি তিনি। মাসিক ২ হাজার টাকা দরে একটি জায়গা ভাড়া নিয়েছেন। সেখানে একটি টিনের কাঁচাঘর তুলেছেন তিনি। তিন সন্তানের মধ্যে এক মেয়ে ২ ছেলে রয়েছে। এখানে থেকেই মেয়েকে বিয়ে দিছেন তিনি। ছেলেও বড় হয়েছে। বাড়ির পাশেই একটি চায়ের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। 

বেলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার সবকিছু এখানেই। সমুদ্রের পাশে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি। ঘূর্ণিঝড় হওয়ায় জিনিসপত্র নিয়ে সমুদ্রের পাড় থেকে কয়েকগজ দূরে বেড়িবাঁধে চলে এসেছি। আশ্রয়কেন্দ্রে যাব না। জিনিসপত্র ফেলে ওইখানে গিয়ে কী হবে? যা হওয়ার এখানে হবে। তবে গত ঘূর্ণিঝড়ে এখানে কিছু হয়নি। বেড়িবাঁধের অনেক নিচে পানি ছিল। ইনশাআল্লাহ এবারও কিছু হবে না। এটা আশ্রয়কেন্দ্রের চেয়েও নিরাপদ। জেলা প্রশাসন থেকে অফিসাররা এসেছিলেন। তাদের আমরা এটা বলেছি।

বেলালের মতো এই বেড়িবাঁধকে নিরাপদ মনে করে একই এলাকার বাসিন্দা জেলে জগদীশ দাশ। তার মতেও এখানে থাকা আশ্রয়কেন্দ্রের মতো নিরাপদ। পাশাপাশি নৌকাসহ বাড়িঘরের মালামাল দেখভাল করা যাবে। জগদীশের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। ভাঙনের কারণে তিনি সেখান থেকে প্রথমে সন্দ্বীপে যান। সেখানে প্রায় ১৫ বছর থাকেন। এরপর সেখানেও ভাঙনের কারণে বারবার বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেলে আশ্রয় নেন আকমল আলী ঘাট জেলে পাড়ায়। এখানে আসছে প্রায় ১৬ বছর হলো। পরিবার নিয়ে একটি ভাড়া ঘরে থাকেন জগদীশ। তার ৪ ছেলে-মেয়ে রয়েছে। নিজের মালিকানাধীন একটি নৌকা রয়েছে। এই নৌকা দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।

বেলালের টাঙানো অস্থায়ী তাবুতে চা খেতে খেতে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে থাকব। সৃষ্টিকর্তা যা করার করবে। তিনি সৃষ্টি করেছেন, নিয়ে গেলে আর কী করব? আমি বাড়ি ছেড়ে গেলে নৌকাটা ভেসে গেলেও দেখার কেউ থাকবে না। তাছাড়া অনেক উঁচু বেড়িবাঁধ এটি। এটিতে পানি উঠলে চট্টগ্রাম শহরের বেশিরভাগ এলাকায় পানি উঠবে। একারণে এখান ছেড়ে কোথাও যাব না। 

শনিবার (১৩ মে) বিকেলে সরেজমিনে আকমল আলী ঘাট এলাকার জেলে পাড়ায় দেখা গেছে, এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫০ পরিবার থাকেন। সমুদ্রের সঙ্গে অনেকটা লাগোয়া তাদের বসতি। এই এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দারা এখনও বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি। তাদের কেউ উপকূলের পাশে জলাশয়ে মাছ ধরছেন, কেউ বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ মালামাল পাশে আউটার রিং রোডে নিয়ে আসছেন। 

কেউ জটলা পাকিয়ে গল্প করছেন আবার কেউ কেউ চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে খুব বেশি আতঙ্ক তাদের মধ্যে নেই। অনেকটা স্বাভাবিক মেজাজেই রয়েছেন তারা। ভীতি থাকলেও সেটি তেমন প্রকাশ পাচ্ছে না। বেশিরভাগের ধারণা তেমন কিছু হবে না। আবহাওয়া খারাপ হলে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেবেন। তবে এলাকায় স্বেচ্ছাসেবীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে হ্যান্ডমাইক দিয়ে সতর্ক করে যাচ্ছে। তারা মাইকে লোকজনকে নিরাপদে আশ্রয় নিতে আহ্বান জানাতে দেখা যায়।

এই এলাকায় জেলা প্রশাসন শুক্রবার বিকেলে নিরাপদে লোকজন সরে যেতে প্রচারণা চালায়। আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান নিজেই শুক্রবার দিবাগত রাত ২টায় স্থানীয় কাউন্সিলরকে নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন। তারপরও মানুষকে নিরাপদে সরে যাওয়ার বিষয়ে উদাসীন দেখা যায়। 

এদিকে, শনিবার দুপুরে নগরের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি লোকজনকে দ্রুত নিরাপদে আশ্রয় নিতে আহ্বান জানান। এসময় নিরাপদে আশ্রয় নিতে যাওয়া লোকজনকে মালামাল সরাতে যানবাহন দিয়ে সহায়তা করে চসিক। 

চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিস থেকে জানা যায়, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (৮৯ মিলিমিটার পর্যন্ত) বর্ষণ হতে পারে। এর ফলে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে।

একারণে চট্টগ্রাম নগরে ২৬ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরত প্রায় সাড়ে ৬ হাজার বাসিন্দাকে নিরাপদে সরাতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। শনিবার নগরের আকবর শাহ থানার ফয়েজ লেক সংলগ্ন ১ নম্বর ঝিল, ২ নম্বর ঝিল, ৩ নম্বর ঝিল, শান্তিনগর এলাকা, খুলশী থানার লালখান বাজারের মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, পোড়াকলোনী পাহাড়, চান্দগাঁও থানার আমিন জুট মিলস পাহাড়, টাংকির পাহাড়, ভেড়া ফকিরের পাহাড়, বার্মা কলোনিসহ পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন জানায়, ঘূর্ণিঝড় মোখার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমাতে চট্টগ্রাম শহর ও বিভিন্ন উপজেলা মিলিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে ১ হজার ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা ৫ লাখ এক হাজার ১১০ জন। জেলায় ৮ হাজার ৮৮০ জন সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তারা আবহাওয়া বার্তা প্রচার করছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের রেসকিউ বোট ও মেডিকেল টিম। পর্যাপ্ত সরঞ্জামসহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের টিম প্রস্তুতও রাখা হয়েছে। 

জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, সম্ভাব্য দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় মানুষকে সচেতন করতে মাইকিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। লোকজন নিরাপদের স্থানান্তর করতে আমি নিজে শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা পর্যন্ত ঘরে ঘরে গিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলায় ত্রাণ কার্য হিসেবে চাল ও নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে জেলা ত্রাণ এবং পুনর্বাসন কর্মকর্তার সঙ্গে ও জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের নম্বরে যোগাযোগ করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলা পুলিশের ১৭টি থানায় দায়িত্বরত এবং ব্যাকআপ হিসেবে মোট ২ হাজার পুলিশ সদস্য প্রস্তুত রয়েছে। জেলায় মোট ২৫০ কিলোমিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ আছে। তন্মধ্যে ১২ দশমিক ৭ কিলোমিটার বাদে বাকি অংশ সুরক্ষিত রয়েছে। জেলায় দুটি সিএসডি এবং ১৬টি এলএসডি রয়েছে। মজুতকরা খাদ্যশস্যের সুরক্ষার জন্য কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মস্থলে উপস্থিত রয়েছেন। গুদামের অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ ঠেকাতে বাফেল ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে শনিবার ভোর থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তবে তা পরিমাণে খুবই কম। আকাশ মেঘলা রয়েছে। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী শনিবার সকাল ৩টা থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয় ২ দশমিক ২ মিলিমিটার।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। জেটি থেকে বড় জাহাজ বের করে বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে লাইটার জাহাজকে কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতু এলাকায় নিরাপদে অবস্থান নিতে বলা হয়। এছাড়া শনিবার ভোর ৬টা থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। পরদিন রোববার রাত ১২টা পর্যন্ত বিমান ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়েছে।

এমআর/এসএম