মিতু হত্যা : বিকাশে তিন নাম্বারে ৩ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য
চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মোকলেছুর রহমান ইরাদ (৩২) নামে একজন। তিনি সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল ইসলামের কর্মচারী। ইরাদ পাবনা জেলার ঈশ্বরদী পৌরসভার মধ্যম শরণখোলা গ্রামের বাসিন্দা।
মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে তিনি সাক্ষ্য দেন। তার দেওয়া সাক্ষ্যতে মূলত মিতু হত্যার পর বিকাশে ৩ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য উঠে আসে। যদিও এর আগে ২০২১ সালের ২৫ মে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিনি জবানবন্দি দিয়েছিলেন।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যতে ইরাদ বলেন, ‘২০১৪-২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় মাল্টিয়ার প্রিন্ট অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে চাকরি করতাম। ২০১৬ সালের ৫ মে কোম্পানির এমডি সাইফুল ইসলাম আমাকে অ্যাকাউন্ট থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের সাথে কথা বলতে বলেন। বাবুল আক্তার স্যারের প্রমোশন হয়েছে। যেখানে মিষ্টি পৌঁছাতে বলে সেখানে পৌঁছাবে। ওনার ফোন নম্বর দেন। আমি ওনাকে ফোন দিই। তিনি আমাকে ৬ কেজি মিষ্টি, ২ কেজি করে আলাদা আলাদা তিন রকম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের পাশে ওনার বোনের বাসা আবুল কালাম আজাদের বাসায় দিয়ে আসতে বলেন। ওই প্রথম আমি বাবুল আক্তার স্যারকে ফোন দিই।’
তিনি বলেন ‘এরপর মিতু ভাবি মার্ডারের পর ২০১৬ সালের ৫ জুন তারিখের দুদিন পর সাইফুল স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের শ্বশুর বাড়ি রাজধানীর বনশ্রী মেরাদিয়া ভুঁইয়া পাড়ায় যান। সেখানে সারাদিন অবস্থান করে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করি। এরমধ্যে বাবুল স্যারের ছেলেমেয়ের সঙ্গে সেলফি তুলি। সেটা আমার ফেসবুকে আপলোড করি। পরে আনুমানিক বিকেল ৩টা বাজে এমডি সাইফুল স্যার আমাকে দ্রুত অফিসে যেতে বলেন। আমি মোহাম্মদপুর বছিলায় আমাদের অফিসের অ্যাকাউনট্যান্ট মামুনের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা গ্রহণ করি। এরপর সাইফুল স্যারকে ফোন দিই, টাকাটা কি করব? তখন সাইফুল স্যার বলেন, তুমি তো বাবুল স্যারের বোনের বাসা চিনই। সেখানে টাকাটা পৌঁছে দাও। ওনার নির্দেশনা মতো টাকাটা বাবুল আক্তার স্যারের বোনের বাসায় দিয়ে অফিসে চলে আসি।’
বিজ্ঞাপন
ইরাদ বলেন, ‘পরদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে এমডি স্যার ফোন দেন। তিনি আবদুল্লাহ আল মামুন নামের একজনের নম্বর দিয়ে আবার তিন লাখ টাকা বাবুল আক্তার স্যারের বোনের বাসা থেকে নিতে বলেন। টাকাটা যখন রিসিভ করি তখন বাবুল আক্তার স্যারের বাবাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। টাকাটার সঙ্গে নামসহ দুটি মোবাইল নম্বরও পাই। তারা হলেন আনোয়ার এবং ওয়াসিম। সাইফুল স্যারকে আবার ফোন দিই। তিনি আমাকে তিনটা নম্বরে এক লাখ করে মোট তিন লাখ টাকা বিকাশ করতে বলেন। বিকাশ পার্সোনাল, গ্রামীণ নম্বর। আমি আবুল কালাম আজাদ স্যারের বাসার দোতলা থেকে নেমে আসতেই, বাবুল আক্তারের বাবা বলেন তুমি কোথায় যাচ্ছ। বললাম বাবুল স্যারের টাকা বিকাশ করব। তিনি আমার সঙ্গে যেতে চাইলেন। আমি ওনার সঙ্গে সেলফি তুললাম এবং ফেসবুকে তখনই সেটা আপলোড করলাম।’
‘পরবর্তীতে অফিসের মোটরসাইকেল নিয়ে আমি ও বাবুল স্যারের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে গাউছুল আজম মার্কেটের নিচতলায় বিকাশের দোকানে যাই। এসময় বাবুল স্যারের বাবা বলেন, আমি বাইরে থাকি তুমি যাও। আমি ওখান থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো সেন্ড করতে পারি। তারপর আমি বাবুল আক্তারের বাবাকে বোনের বাসায় রেখে অফিসে চলে যাই। এরপর সাইফুল স্যারকে জানাই, ৭০ হাজার টাকা আছে। তখন অফিসের পাশের রিপন টেলিকম থেকে ৭০ হাজার টাকা রাত ৯টায় পাঠাই।’
দীর্ঘদিন পর ২০২১ সালের ২২ মে আমাকে পাবনা পিবিআই অফিস থেকে ফোন দেয়। ২৪ মে আমি পিবিআই অফিসে যাই। তারা একটি কাগজ দিয়ে চট্টগ্রাম পিবিআই অফিসে আসতে বলে। পিবিআই কর্মকর্তারা বলেন টাকা লেনদেনের বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে। তোমাকে চট্টগ্রামে যেতে হবে। পিবিআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি চট্টগ্রামে রওনা দিই। ঢাকা আসার পর গাড়ি চেঞ্জ হয়, অন্য গাড়িতে আমি উঠি। তখন পিবিআইর লোকজন চেঞ্জ হয়। তারা বিকাশের দোকানগুলো চিনিয়ে দিতে বলে। দোকানগুলো চিনিয়ে দিই সেই রাতে। তারপরে আমাকে আবার বলে যেখান থেকে টাকা নিয়ে এসেছ, সেটা দেখিয়ে দাও। সেটা ছিল বাবুল আক্তারের বোনের বাসা। পরে তারা আমাকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী পিবিআই অফিসে নিয়ে যায়, তখন রাত ৪টা। সেখানে ঘুমানোর জন্য ৫তলায় একটা রুম দেয়। সকাল ৯টার দিকে পিবিআইর অফিসার সন্তোষ চাকমা আমার বিবরণ শোনেন। পরে আমার ছবিগুলো মোবাইলে পায়। তখন ফোনটা জব্দ করে। ফোনটা ছিল আইফোন। সন্তোষ স্যার আমাকে দুপুর দুইটার দিকে কোর্টে নিয়ে যান। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের কাছে আমি জবানবন্দি দিই।'
চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদূর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদিনে গুরুত্বপূর্ণ তিনজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ নিয়ে মামলাটিতে মোট ৬ জনের সাক্ষ্য সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল (সোমবার) পলাতক আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছার স্ত্রী পান্নার সাক্ষ্য এবং জেরা শেষ হয়। এরপর বাবুল আক্তারের প্রেমিকা গায়ত্রীর বাসার কেয়ারটেকার সারোয়ার আলম সাক্ষ্য এবং জেরা হয়। তার জেরা বাকি ছিল। এটি আজ (মঙ্গলবার) সকালে শেষ হয়। এরপর আজকে মোকলেছুর রহমান ইরাদের সাক্ষ্য এবং জেরা সম্পন্ন হয়। আগামী ৮ আগস্ট মামলাটির পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
তবে মামলাটিতে স্ত্রী হত্যাকাণ্ডে স্বামী বাবুল আক্তারেরই সম্পৃক্ততা পায় পিবিআই। ২০২১ সালের ১২ মে আগের মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। একই দিন বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। ওইদিনই মামলাটিতে বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে পিবিআই। সেই থেকে কারাগারে রয়েছেন বাবুল।
এদিকে, প্রথম মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর নারাজির আবেদন করেন বাবুলের আইনজীবী। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৩ নভেম্বর নারাজি ও পিবিআইয়ের প্রতিবেদন খারিজ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। এরপর দুটি মামলাই তদন্ত করতে থাকে পিবিআই। তবে পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছরের ২৫ জানুয়ারি মিতুর বাবার দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরপর একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম মামলাটি অধিকতর তদন্ত শেষে বাবুলসহ ৭ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
গত ১৩ মার্চ আলোচিত মামলাটিতে বাবুল আক্তারসহ সাত আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
এমআর/জেডএস