ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ সুপার কার্যালয়ের গাড়ি ও মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় দুবৃর্ত্তরা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ওই প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটে। ঢাকার বাইরে এসব ঘটনার কেন্দ্রে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ওই এলাকায় ২৬ থেকে ২৮ মার্চ দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন অন্তত ১০ জন। বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর করে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে। আগুন দেওয়া হয় ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনেও’।

টানা তিনদিনের তাণ্ডব নিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা ঢাকা পোস্টকে জানান ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি। ২৭ মার্চ তাঁকেও কুপিয়ে জখম করে হেফাজতের দুর্বৃত্তরা।

আরও পড়ুন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজত-পুলিশ সংঘর্ষ, নিহত ৩

নিজের ভয়াল অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, “সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে এসে দেখি হেফাজতের ৭০-৮০ জন কর্মী দাঁড়িয়ে আছে। যদিও তারা সবাই মারমুখী ছিল, তারপরও আমি পালানোর চেষ্টা করিনি। ভেবেছি পালানোর চেষ্টা করলে তারা ধাওয়া করবে। তাই আমি দাঁড়িয়ে থাকি। হঠাৎ তাদের একজন বড় একটি রাম দা বের করে বলে, ‘এইটা প্রেসক্লাবের সভাপতি, আমাদের সংবাদ ঠিকমতো কাভার করে না। আমরা নিউজ একরকম পাঠাইলে আরেক রকম প্রচার করে’। এটা বলেই আমাকে কোপ দেয়া শুরু করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি রক্তাক্ত হয়ে যাই। এরপর একজন এসে বলে ‘ওকে কুপিয়ে মারিস না, আস্তে আস্তে মার’। পরে আমাকে কিল-ঘুষি মারতে থাকে ওরা। আরেকজন পেছন থেকে মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত করে আমাকে মাটিতে ফেলে দেয়। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।”

তাণ্ডবের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন

জামি বলেন, ‘এরপর আমি সদর হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করলে তারা আমাকে বাধা দেয়। হাসপাতালের প্রধান গেট বন্ধ করে দেয়। আমার সহকর্মীরা আমাকে পকেট গেট দিয়ে হাসপাতালে ঢোকান।’ 

হামলার নেপথ্যে যারা

বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কিট হাউজে হামলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ এলাকায় আমরা সবাই একজন আরেকজনকে চিনি। তবে হামলাকারীরা এলাকার ছিল না। সকাল ১০টার পর থেকে এলাকার বাইরে থেকে লোকজন এসেছে। তাদের সবার হাতে দা, লাঠি, বল্লম ছিল। মাদরাসাছাত্রের সংখ্যা ছিল অনেক কম। অধিকাংশই বাইরের। হামলাকারীরা ছিল ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে। তাদের কারও কাঁধে ব্যাগ ছিল, কারও পিঠে বস্তাও ছিল। কারও হাতে পাথরভর্তি গামলা ছিল। কয়েকজন বস্তাভর্তি ইট-পাথর নিয়ে এসেছিল। তারা বেছে বেছে এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মারধর করছিল। পুলিশের লোকজন সকাল থেকে সেখানে থাকলেও বিকেলে  তাণ্ডবের সময় কোনো পুলিশ সদস্যকে সেখানে দেখা যায়নি।’

আরও পড়ুন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩৮ ঘটনাস্থলে সিআইডির ক্রাইমসিন-ফরেনসিক টিম

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা দূর থেকে দেখেছি, ২৭ মার্চ বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আওয়ামী লীগের একটি মিছিল হয়েছিল। মিছিলের পেছনের অংশে একটা ঝামেলা হয়েছিল। এর পরপরই গোলাগুলি শুরু হয়, পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। তারপরই তাণ্ডব শুরু হয়। একপর্যায়ে সাধারণ মানুষ, বিজিবি ও মাদরাসাছাত্রদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে কয়েকজন মারা যায়। তখন এলাকার মসজিদগুলোয় মাইকিং করা হয়, ‘আপনারা সবাই মাদরাসার নিরাপত্তায় এগিয়ে আসুন। তখন সবাই মাদরাসার দিকে এগিয়ে যায়।’

তিনি জানান, ‘হামলার সময় তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গালিগালাজ করে। তাকে আমন্ত্রণ জানানোয় আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়।’

যান চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা

যেসব স্থাপনায় হামলা, অগ্নিসংযোগ 

রোববার (২৮ মার্চ) সকালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের হরতাল চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ কার্যালয়, সার্কিট হাউজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা কার্যালয়, পৌর মিলনায়তন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের কার্যালয় ও বাড়ি এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া হরতালকারীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরাসারের বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের কার্যালয় এবং জেলা পুলিশ লাইনে হামলার চেষ্টা চালানো হয়।

তছনছ ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’

বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে’ গিয়ে দেখা যায় হেফাজতের তাণ্ডবের চিত্র। আগুনে সঙ্গীতাঙ্গনের আসবাবপত্রসহ সব পুড়ে কালচে হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে সবকটি কক্ষ। গিটার, হারমোনিয়ামসহ সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্রের পোড়া অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখানে সেখানে। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে জীবন্ত গাছও! গাছের পুড়ে যাওয়া পাতা এখনো ঝরছে একটি একটি করে।

সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘এখানে শিশুদের সঙ্গীত চর্চা করানো হয়। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। তবে করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে এর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এরমধ্যেই হেফাজতের আন্দোলনকারীরা আগুন দিয়ে সঙ্গীতাঙ্গনটি পুড়িয়ে দিলো। আগুনে প্রতিষ্ঠানটি একেবারে শেষ হয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখা খুবই কষ্টের।’ এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন

তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন প্রেসক্লাবের গায়ে

রোববার (২৮ মার্চ) হরতালের দিন বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব এবং সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করা হয়।

বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রেসক্লাবের বাইরের কাঁচ ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। সেখানে আগুনও দেয়া হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো নেই, খুলে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। এখনও প্রেসক্লাবের অডিটরিয়ামের ভেতরে রয়ে গেছে কাঁচের টুকরো আর ভেঙে যাওয়া আসবাব। 

আইজিপি যা বললেন

বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজতের হামলার শিকার বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শনে যান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। তিনি স্থানীয় লোকজন ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের উন্নয়নে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান দেন আইজিপি। 

হামলার বিষয়ে আইজিপি বেনজির বলেন, যেসব জায়গায় হামলা চালানো হয়েছে সবগুলোই রাষ্ট্রীয় সম্পদ তথা জনগণের সম্পদ। জনগণের সম্পদ কেউ কেন এভাবে নষ্ট করবে তা আমার বোধগম্য নয়। এ জেলায় ৩২ লাখ মানুষ বাস করেন। এখানে ৫৭৪টি মাদরাসা রয়েছে। সবাই পরকালের জন্য এসব মাদরাসায় দান-সদকাহ করে পরিচালনা করেন। অথচ এসব মাদরাসার কোমলমতি ছাত্রদের নাশকতার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধরন দেখে এটা স্পষ্ট যে, দেশের উন্নয়ন ব্যাহত করার জন্য এই হামলা চালানো হয়েছে।

হেফাজতের হরতালে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের হামলার ঘটনায় হেফাজতের কোনো নেতার বিরুদ্ধে মামলা না দেওয়ায় স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন জানিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদেরই গ্রেফতার করা হবে।

এআর/এসকেডি/এসএসএইচ/জেএস