ঠেলাগাড়ি চালক সিদ্দিকুর রহমান/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

প্রতিদিন তিন থেকে চারটি ক্ষ্যাপ পাই। ক্ষ্যাপের সেই টাকা দিয়ে বিকেলে বাজার করে বাসায় যাই। ওই বাজার দিয়েই আজ রাত এবং আগামীকাল দিনের রান্না হয় বাসায়। পরদিন আবার ক্ষ্যাপ মেরে বাজার করে বাসায় ঢুকি। এভাবেই চলে আমার ৫ সদস্যের সংসার। যদি একদিন ক্ষ্যাপ না পাই, তাহলে পরদিন খাওয়া প্রায় বন্ধই থাকে। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই দুঃখের কথা বলছিলেন ঠেলাগাড়ি চালক সিদ্দিকুর রহমান।

শুধু সিদ্দিকুর রহমান না, এমন নিম্নবিত্ত অনেক পেশার মানুষ এখন রাস্তায় কাজের জন্য। যাদের জীবন দু’দিন আগেও চলছিল ঠেলেঠুলে, হঠাৎই তারা এখন পেটের চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত। হন্য হয়ে তারা কাজ খুঁজছেন। 

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে সাত দিনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা চলছে দেশে। সরকারি এ নিষেধাজ্ঞা ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়েছে। এতে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে সারাদেশে। তার প্রভাব পড়েছে এসব দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের উদরে।

মঙ্গলবার (৬ এপ্রিল) রাজধানীর আজিমপুর হোম ইকোনমিক্স কলেজের সামনে ঠেলাগাড়ি নিয়ে অলস বসে থাকতে দেখা যায় সিদ্দিকুর রহমানকে। তিনি অসহায় দৃষ্টিতে দোয়া চেয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার কিয়ের লকডাউন দিছে, তাতে আমগো না খাইয়া থাকার দশা। এই ঠেলা গাড়িই আমার সম্বল। বেবাকদিনের মতো আজকেও এনে বইয়া আছি ব্যবসায়ীগোর ডাকের আশায়। তারা বেবাক দিন এন তনেই আমগো ডাইক্কা নিয়া যায়। তহন দিনে তিন-চারট্যা ক্ষ্যাপ পাই। ক্ষ্যাপ থিকা দিনে ৭-৮শ বা কুনোসুম (কোন সময়) এক হাজার ট্যাকা পাই। কাইল (৫ এপ্রিল) একডা ক্ষ্যাপে ৩০০ ট্যাকা পাইছি। হেডা দিয়া কাইল রাইতে খাইয়া আইজ চলতাছে কোনোমতে। আইজ এহন পন্ত কোনো ক্ষ্যাপ নাই। হেই বেয়ান বেলা (সকাল) থিকা বাইয়া আছি। ক্ষ্যাপ না পাইলে রাইতের খাওন চলবে, তয় কাইল না খাইয়া থাকন লাগব।

তিনি আরও বলেন, আমরা গরিব মানুষ। দিন এনে দিন খাই। সরকার শুধু আমাদের উপরই জুলুম করে। সবাই সব কাজ করছে, শুধু আমাদের কাজই বন্ধ। যত আজাব খালি আমাদের উপরে। দোয়া করবেন যেন একটা ক্ষ্যাপ পাই, বাজার নিয়ে বাসায় যাইতে পারি। 

রাজমিস্ত্রি জিলহাক/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

হয়তো সিদ্দিকুর রহমান এখনও একটি ডাকের আশায় সেখানেই বসে আছেন। এদিকে, নিউ মার্কেটের সামনে রাজমিস্ত্রির কাজের সরঞ্জাম হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় জিলহাককে। ঢাকা পোস্ট তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, কাজের আশায় তিনি সকাল থেকে এখানে আছেন। তিনি বলেন, নিয়মিত ৬০০/৭০০ টাকা মজুরিতে আমি কাজ করে থাকি। গতকালও কাজ পেয়েছি। আজ এখনও পাইনি। পরিবারে ৬ জন মানুষ। আমাদের সাথে যারা কাজ করে, তাদের সবার একই অবস্থা। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ আমরা। সরকার ঘরে বসে থাকতে বললে তো আর খাবার জুটবে না। কাজের তাগিদেই ঘরের বাইরে বের হতে হয়। বড়লোকদের মতো আমাদের অত সঞ্চয় নাই যে, ৭ দিন ঘরে বসে খেতে পারব। আমাদের কথা তো তারা ভাবে না, তারা ভাবে বড়লোকদের কথা।

ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের পাশে কথা হয় দিনমজুর দুলালের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে দিন হিসেবে কাজ করি। কখনও পুরো বাসা পরিষ্কার, কখনও পানির হেড মিস্ত্রীর সহকারী হওয়াসহ বেশ কয়েকটি কাজ করি। এতে দিনে ৫০০ টাকা মজুরি পাই। কিন্তু দুদিন ধরে কোনো কাজ নেই। যাদের সঙ্গে কাজ করি, তাদেরও কাজ নেই। তাই আমারও কাজ নেই। সরকার এভাবে সব বন্ধ করে রাখলে না খেয়ে মরতে হবে।

পুরো ঢাকা শহরে এমন হাজার হাজার দিনমজুর আছে। যাদের দিনের উপার্জন দিয়ে দিনের পুরো পরিবারের খরচ চলে। সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় এমন অনেকের দিনের উপার্জন প্রায় বন্ধ বা বন্ধ হওয়ারও উপক্রম। এমন নিম্নবিত্ত যারা নিজ উপার্জনে সংসার চলান, সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা যদি দীর্ঘ হয় তবে খাবারের সন্ধানে তাদের হয়তো মানুষের কাছে হাত পাততে রাস্তায় নামতে হতে পারে। যেমনটা নামতে হয়েছিল ২০২০ সালে।

এমএইচএন/এইচকে