চিরচেনা সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাটে আনা হয় মো. শহীদুল্লাহকে (৭২)। শুক্রবার (৬ অক্টোবর) উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে। উপজেলার মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের এই বাসিন্দার এটিই ছিল অন্তিম সাগরযাত্রা। জীবদ্দশায় তিনি কতবার এই ঘাট দিয়ে সাগর পার হয়েছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। প্রতিবারই এই সাগর পারাপারে গুনতে হয়েছে নির্দিষ্ট ভাড়া।

তবে চোখ বন্ধ অবস্থায় জীবনের এই শেষ যাত্রায় তার স্বজনদের দিতে হয়নি কোনো ভাড়া। শহীদুল্লাহর ছোট ভাই মাহফুজুর রহমান বলেন, আমার বড় ভাইয়ের মরদেহ নিতে আমরা টাকা দিতে চেয়েছিলাম। আমাদের সামর্থ্যও আছে। কিন্তু ঘাট থেকে কোনো টাকা নেয়নি। মরদেহের সঙ্গে আমাদেরকেও বিনামূল্যে যেতে বলা হয়েছিল। এভাবে সন্দ্বীপের সব মরদেহ বিনামূল্যে পারাপার করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায় যেতে সাগর পাড়ি দিতেই হবে। এক্ষেত্রে কুমিরা-গুপ্তছড়া প্রধান পথ। এ ঘাটের ইজারাদার এস এম আনোয়ার হোসেন চেয়ারম্যান। বিনামূল্যে মরদেহ পারাপার তার মানবিকতায় সম্ভব হচ্ছে। কারণ মরদেহ পরিবহনে ভাড়া না নিতে তিনি বাধ্য নন। জেলা পরিষদ থেকে ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো শর্ত ছিল না। চাইলেই তিনি নিতে পারেন নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া। তার আগের ইজারাদার মরদেহ পরিবহনে ভাড়া নিতেন, যা ছিল সাধারণ ভাড়ার চেয়ে বেশি।

ঘাটে থাকা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই কুমিরা থেকে গুপ্তছড়া ঘাট পর্যন্ত দুয়েকজনের মরদেহ পার করতে হয়। আনোয়ার চেয়ারম্যান এই ঘাটের ইজারা নিয়েছেন ২০১৩ সালে। গত প্রায় ১০ বছরে তিনি এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মরদেহ পার করিয়েছেন। কিন্তু কারো স্বজনের কাছ থেকে এক টাকাও নেননি।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা ধস হয়। নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার কয়েকজন ছিলেন। সীতাকুণ্ডের কুমিরা থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট পারাপারে প্রতিটি লাশ বাবদ গুনে গুনে ২০ হাজার টাকা নেন তৎকালীন ঘাটের ইজারাদার। এ কারণে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন সন্দ্বীপের মানুষ। ওই বছরই ঘাটের ইজারাদারের দায়িত্ব নেন আনোয়ার হোসেন চেয়ারম্যান।

সন্দ্বীপ উপজেলার মগধারা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল হান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতার আগে পালতোলা নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতাম। স্বাধীনতার পর কাঠের নৌকা। এক যুগ আগে থেকে স্পিডবোটে যাতায়াত শুরু হয়। সাগর পারাপারে নানা সুবিধা-অসুবিধে থাকতে পারে। তবে ২০১৩ সাল থেকে বিনামূল্যে মরদেহ পারাপার উল্লেখ করার মতো বিষয়। আনোয়ার চেয়ারম্যানের মানবিকতায় এটা সম্ভব হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম আনোয়ার হোসেন চেয়ারম্যান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০১৩ সালে ঘাটের ইজারা নিয়েছি। প্রথমে ঘোষণা দিয়েছি মরদেহ পারাপারে কোনো টাকা নেব না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে জনপ্রতি স্পিডবোটে ভাড়া নেওয়া হতো ৪০০ টাকা। ভিড় থাকলে ৪৫০ টাকাও নেওয়া হতো। দায়িত্ব নেওয়ার পর ভাড়া প্রথমে ৩৫০ টাকা, দুই বছর পর কমিয়ে ৩০০ টাকা করা হয়। তারও এক বছর পর আরও কমিয়ে ২৫০ টাকা করেছি। সবশেষ এ বছর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর ভাড়া ৩৮০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, আগে রাতে রোগী মারা গেলেও পার করা হতো না। কিন্তু এখন আমি রাত-বিরাতে রোগী পার করি। গরিব-অসহায় হলে বিনামূল্যে পার করি। অথচ আমাকে প্রতিদিন ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৯৩ হাজার ৭৫০ টাকা জেলা পরিষদে ইজারা বাবদ দিতে হয়। ইজারা নেওয়ার পর থেকে লোকজন পারাপারকে ব্যবসা হিসেবে দেখিনি। এটাকে মানবসেবা হিসেবে নিয়েছি। কাদামাটি মাড়িয়ে যাতে যেতে না হয়, সেজন্য গুপ্তছড়া ঘাটে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে কাঠের ব্রিজ করেছি। এটি আবার প্রতিনিয়ত সংস্কার করতে হচ্ছে।

এমআর/এসএসএইচ