টার্মিনাল-স্টেশন থেকে যাত্রী পরিবহনের বাস, ট্রেন, নৌযান চলাচল বন্ধ হয়েছে আগেই। চৈত্রের দাবদাহ মাথায় নিয়ে অসংখ্য নারী-পুরুষ হেঁটে চলেছেন। কারও কোলে ছোট শিশু। কারও কারও মাথায় বড় বড় বস্তা-ব্যাগ, দুই হাতও বাদ যায়নি কারও। প্রথমে তারা জড়ো হয়েছিলেন গাবতলী বাস টার্মিনালের সামনে। কিন্তু সেখানে বাস নেই। টার্মিনাল থেকে দূরে আমিনবাজার কিংবা হেমায়েতপুরে গেলে বাস মিলবে— সেই ভরসায় সবাই দলে দলে ছুটছিলেন।

গাবতলীতে দূরপাল্লার কোনো পরিবহন না পেয়ে আমিনবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন জামশেদ আলী। শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছিল, মাথার ওপর বড় কার্টন। জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি কিন্তু এমন কষ্ট আর করি নাই।’

ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, সরকারের কঠোর নির্দেশনার মধ্যে কোনো কাজকর্ম পাবেন না। এ কারণে খুলনায় নিজ বাড়িতে ফিরছেন। মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় তিনি গাবতলী আসেন। কিন্তু সেখানে কোনো পরিবহন না পেয়ে সবার মতো আমিনবাজারের উদ্দেশে ছুটছিলেন, যদি সেখানে কোনো বাহন মেলে।

১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত কার্যত লকডাউনে যাচ্ছে দেশ। বন্ধ থাকছে অফিস-আদালত। তাই ঢাকা ছাড়ছেন মানুষ। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, স্বল্প আয়ের মানুষের বড় একটি অংশকে এদিন (মঙ্গলবার) ঢাকা ছাড়তে দেখা যায়

জামশেদের মতো হাজার হাজার মানুষ ট্রাকে করে, কেউ পিকআপে অথবা কাভার্ড ভ্যানের ভেতরে গাদাগাদি করে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন।

১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত কার্যত লকডাউনে যাচ্ছে দেশ। বন্ধ থাকছে অফিস-আদালত। তাই ঢাকা ছাড়ছেন মানুষ। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, স্বল্প আয়ের মানুষের বড় একটি অংশকে এদিন (মঙ্গলবার) ঢাকা ছাড়তে দেখা যায়।

রাজধানী ঢাকায় প্রায় দুই কোটি লোকের বাস। ঢাকা ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তিনদিনের ব্যবধানে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ রাজধানী ছেড়েছেন। পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য জানান। তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর সরকার প্রথমবারের মতো সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু ওই সময় এত লোক ঢাকা ছাড়েননি।

দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ তাই যে যেভাবে পারেন ঢাকা ছাড়ছেন। মঙ্গলবার রাতে গাবতলী থেকে তোলা ছবি

বেশির ভাগ দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকলেও এসব মানুষ পণ্য পরিবহনের বিভিন্ন বাহন, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটছেন। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ যাত্রীকে ভেঙে ভেঙে বাহন পরিবর্তন করে যেতে হচ্ছে। নদীপথে ট্রলারে, স্পিডবোটে, ফেরিতেও ছিল উপচেপড়া ভিড়।

এদিন দুপুরে পাটুরিয়া যাবার জন্য কোনো বাস না পেয়ে মোটরসাইকেলে সহযাত্রী হয়ে রওনা দেন শফিকুর রহমান। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, ভেঙে ভেঙে এভাবে রাজবাড়ী যেতে চান। পাটুরিয়া পর্যন্ত মোটরসাইকেলে যেতে তাকে দিতে হবে ১২০০ টাকা। এত ভাড়া দিয়ে কেন যাচ্ছেন— প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘গুলিস্তানে হকারি করি। বুধবার থেকে তাও বন্ধ হচ্ছে। তাই বাড়ি ফিরছি।’

রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী, ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। তারপরও এসব টার্মিনাল এবং এর আশপাশ থেকে ঘরমুখী মানুষের বড় একটি অংশ জড়ো হচ্ছিলেন ঢাকার প্রবেশমুখ কাঁচপুর-যাত্রাবাড়ী, টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর, পোস্তগোলা, রামপুরা-ডেমরা এলাকায়।

সোমবার দুপুরে যাত্রীসেবা পরিবহনের বাসে রওনা দিয়ে নোয়াখালী যাচ্ছিলেন কিছু যাত্রী। কুমিল্লার মহাসড়কে পুলিশ তাদের আটকে দেয়— এমন উদাহরণ দিয়ে পরিবহন খাতের নেতারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দূরপাল্লার বাস চলতে দিলে এমন ভোগান্তি দেখতে হতো না

‘সোমবার দুপুরে যাত্রীসেবা পরিবহনের বাসে রওনা দিয়ে নোয়াখালী যাচ্ছিলেন কিছু যাত্রী। কুমিল্লার মহাসড়কে পুলিশ তাদের আটকে দেয়’— এমন উদাহরণ দিয়ে পরিবহন খাতের নেতারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দূরপাল্লার বাস চলতে দিলে এমন ভোগান্তি দেখতে হতো না।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অধীনে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন আছে ২৫০টি। পরিবহন খাতের সবচেয়ে বড় এই ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত তিনদিনে ঢাকা থেকে কম হলেও ৫০ লাখ লোক বাড়ি গেছেন। কার্যত লকডাউনের আগে ঢাকায় কর্মসংস্থান নিয়ে সংশয়ে থাকা স্বল্প আয়ের মানুষরা বেশি ঢাকা ছেড়েছেন। আমরা যাত্রীদের এমন চাপ বাড়বে বলে সরকারের কাছে ১২ ও ১৩ এপ্রিল দূরপাল্লার বাস চালানোর অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার অনুমতি দেয়নি। এখন মানুষ দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।’

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাখালী টার্মিনাল শাখার সভাপতি আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অর্ধকোটির বেশি মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। এ কারণে এ টার্মিনালের সামনে থেকে এবং বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকে, পিকআপে, ব্যক্তিগত গাড়িতে মানুষ বাড়ি গেছেন। তবে, নিষেধাজ্ঞার পরও কিছু বাস চলাচল করেছে, বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

গত তিনদিনে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন, বলছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যাত্রীদের বড় কষ্ট হচ্ছে। পণ্যবাহী ট্রাকে উঠে তারা বাড়ি যাচ্ছেন। ঢাকা থেকে যেন ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে সাধারণ সময় আট থেকে ১০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ ১১ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১২ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ৩০ হাজার পরিবহন পার হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু বিভাগের কাছে আসা তথ্য থেকে জানা গেছে, পণ্য পরিবহনের বিভিন্ন যানবাহন, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল বেশি পার হয়েছে। এর মধ্যে যাত্রাবাহী বাসও ছিল।

এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ইয়াসির আরাফাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। দিনে না চললেও গভীর রাতে যাত্রীবাহী বাস চলাচল করেছে।

এদিকে ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধিরা জানান, মঙ্গলবারও শিমুলিয়াঘাটে ঘরমুখী মানুষের চাপ বেড়ে যায়। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। ফেরিতে গাদাগাদি করে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ পদ্মা পাড়ি দেন। এছাড়া ইঞ্জিনচালিত ট্রলার-স্পিডবোটেও অতিরিক্ত ভাড়া গুনে যাত্রী পার হন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাট এলাকায় শত শত যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় ছিল।

শিমুলিয়া ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়াত আহম্মেদ বলেন, ঘাট এলাকায় যাত্রীর চাপ এত বেশি যে কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। ঈদের সময় যেমনটি হয় ঠিক একই পরিস্থিতি আজ সারাদিন দেখা গেছে।

গতকাল সোমবার লকডাউন চলাকালে পণ্যবাহী পরিবহন যাতে কোনোভাবেই যাত্রীবাহী পরিবহনে রূপ নিতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছিলেন, ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণায় লঞ্চ ও ফেরিঘাটে ঘরমুখী মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। কেউ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এ ধরনের মনোভাব করোনার সংক্রমণকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই আমি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।

প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়মিত আদালত পরিচালনা করতে হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন ওবায়দুল কাদের। মন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না— জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আমাদের সীমিত জনবল নিয়ে তৎপর। বিভিন্ন জেলা প্রশাসনও এ বিষয়ে তৎপর। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

আগামীকাল থেকে লকডাউন। তাই যে যেভাবে পারেন রাতেও ঢাকা ছাড়ছেন

এভাবে বাড়ি ফেরার বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা প্রতিরোধে সরকার বিধিনিষেধ দিয়েছে। বিধিনিষেধ ঘোষণার পরপর সাধারণ মানুষ যেভাবে পারেন গ্রামে যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। গণপরিবহন না থাকায় তারা যেভাবে গাদাগাদি করে যাচ্ছেন, এভাবে একজন থেকে অন্যজন সংক্রমিত হবেন। স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং মানতে বাধ্য করা শুধু শহরে নয়, গ্রামেও করতে হবে। সারাদেশের মানুষকে সুরক্ষার ছায়ায় নিয়ে আসতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা মানুষও যদি অরক্ষিত থাকে, তাহলে পুরো দেশ সুরক্ষিত হবে না।

‘আমরা দেখছি, গ্রামের মানুষ করোনা বা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। কিন্তু প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। সেগুলো সরকারের হিসাবে আসছে না। আমরা প্রতিদিন যে ৬০, ৭০, ৭৫ জনের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি, সেগুলো কিন্তু গ্রামাঞ্চলের পরিসংখ্যান নয়। গ্রামগুলোতেও আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। আমরা যদি টেস্টের সংখ্যা বাড়াই, গ্রামপর্যায়ে নিয়ে যাই, তাহলে গ্রামের মানুষও টেস্টের আওতায় আসবেন। ফলে শহরের ওপর চাপ কমবে। সরকারকে গুরুত্বসহকারে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

পিএসডি/এমএআর