বাবা আবুল কাশেমের কবরের সামনে নিউইয়র্ক প্রবাসী ছেলে সাখাওয়াত কবির

বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে সুদূর নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফেরেন সাখাওয়াত কবির। কিন্তু বাবার সান্নিধ্য আর পাওয়া হলো না। করোনা কেড়ে নিল প্রিয় বাবার প্রাণ। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও গত ১০ এপ্রিল (শনিবার) দেশে পৌঁছান সাখাওয়াত কবির। ওইদিন রাতেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাবা আবুল কাশেম। এত কাছে এসেও বাবাকে ভালো করে দেখা হলো না, সুযোগ মিলল না সেবা করার। 

মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) বাবার কবর জেয়ারত করতে এসেছেন নিউইয়র্ক প্রবাসী সাখাওয়াত কবির। চোখের কোণে পানি আর ভারী হয়ে আসা কণ্ঠে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।  বাবা আবুল কাশেমের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘বাবার সান্নিধ্য প্রতি মুহূর্তে মিস করি, অনেক অনেক বেশি মিস করি। বাবা ছাড়া এ পৃথিবী এখন শূন্য মনে হয়।’ প্রিয় বাবাকে জীবিত অবস্থায় ছুঁয়ে দেখতে না পারলেও কবরের মাটি স্পর্শ করে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে দেখা যায় তাকে।

শুধু সাখাওয়াত কবিরের বাবা নন, রাজধানীর রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকে ঘুমিয়ে আছেন শত শত মানুষের প্রিয়জন। মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে দেশের সর্ববৃহৎ এ কবরস্থান ঘুরে দেখা যায়, দুপুরের তপ্ত রোদের মধ্যেও অনেকে এসেছেন কবর জিয়ারত করতে। প্রবাসী সাখাওয়াত কবীরের মতো এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অতি সম্প্রতি করোনার আঘাতে তাদের প্রিয়জন হারিয়েছেন। কেউ বাবা হারিয়েছেন, কেউ মা, কেউবা আত্মীয়-স্বজন। হঠাৎ করোনায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তাদের হারিয়ে শোকে স্তব্ধ সবাই।

শেষবেলা বাবাকে স্পর্শ করা হয়নি, এখন কবরের মাটি স্পর্শ করেই সান্ত্বনা খুঁজছেন ছেলে 

কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকের পূর্বপাশে খালা আয়েশা বেগমের কবর। সেখানে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করছিলেন আশরাফুল আলম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলন, ‘গত মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করোনায় আক্রান্ত হন খালা। খুব দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েন। দুদিনের মাথায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সেবা করারই সুযোগ দিলেন না। তাকে হারিয়ে আমরা শোকাহত। মাঝে মাঝে এখানে আসি, কবর জিয়ারত করে যাই।’

এদিকে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় রায়েরবাজার কবরস্থানের গোরখোদকরা এখন ব্যস্ততম সময় পার করছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন দাফন সম্পন্ন করা যায় সেজন্য আগে থেকেই তারা খবর খুঁড়ে রাখছেন। সরেজমিনে কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকের পূর্ব ও পশ্চিমপাশ ঘুরে দেখা যায়, নতুন করে প্রায় ২০টা কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। গোরখোদকরা জানান, করোনার আগে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি মরদেহ দাফনের জন্য আসত। এখন প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি মরদেহ দাফন করতে হচ্ছে। অধিকাংশই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন।

তারা আরও জানান, কফিনেও আনা হচ্ছে অনেক মরদেহ। দাফনের পর স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো করে কফিনগুলো পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।

রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লক, খুঁড়ে রাখা হচ্ছে সারি সারি কবর

কবর পরিচর্যায় নিয়োজিত আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাঝে কিছুদিন ৮ নম্বর ব্লকে দাফনের সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু এখন বেড়েছে। প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন অনেক মানুষ। তবে এবার গতবারের মতো চিত্র চোখে পড়ছে না। গতবার মরদেহের সঙ্গে স্বজনরা আসতেন না, ভয় পেতেন। কিন্তু এবার স্বজনরা আসছেন, প্রিয়জনদের শেষ বিদায় জানাচ্ছেন।

এছাড়া মরদেহের সঙ্গে আসা স্বজনদের স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

চারদিন পর একশ’র নিচে মৃত্যু

দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১০ হাজার ৫৮৮ জনে। এর আগে শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত টানা চারদিন মৃতের সংখ্যা ছিল একশ’র অধিক।

রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকে ঘুমিয়ে আছেন শত শত মানুষের প্রিয়জন

গতকাল সোমবার (১৯ এপ্রিল) ভাইরাসটিতে ১১২ জনের মৃত্যু হয়। যা দেশে একদিনে ছিল সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগের তিনদিন অর্থাৎ ১৬, ১৭ ও ১৮ এপ্রিল করোনায় মারা যান যথাক্রমে ১০১, ১০১ ও ১০২ জন।

মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন চার হাজার ৫৫৯ জন। এতে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল সাত লাখ ২৭ হাজার ৭৮০ জনে।

গত ২৪ ঘণ্টায় করোনামুক্ত হয়েছেন ছয় হাজার ৮১১ জন। এখন পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৬ লাখ ২৮ হাজার ১১১ জন।

২৪ ঘণ্টায় ২৭ হাজার ২৭৯৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ২৭ হাজার ৫৬টি। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। দেশে এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫২ লাখ ২১ হাজার ২৭৫টি। মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

প্রতিদিনই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা, তাই আগে থেকেই খুঁড়ে রাখা হয়েছে ২০টি কবর

গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ৯১ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগেরই ৬০ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ১৭, রাজশাহীতে ৩, খুলনায় ৫, বরিশালে ৪ এবং রংপুরে ২ জন মারা গেছেন। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৫৮ জন পুরুষ এবং ৩৭ জন নারী। এদের মধ্যে ৮৮ জন হাসপাতালে, ২ জন বাড়িতে ও একজনকে হাসপাতালে আনার পথে মারা গেছেন। এ পর্যন্ত ভাইরাসটিতে মোট মারা যাওয়া ১০ হাজার ৫৮৮ জনের মধ্যে পুরুষ ৭ হাজার ৭২৭ জন এবং নারী ২ হাজার ৭৬১ জন।

বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৫৪ জনেরই বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের ১৮, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ১১, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৭ এবং ১১ থেকে ২০ বছরের একজন রয়েছেন।

আরএইচটি/এমএআর/জেএস