বর্ডার পেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্স হয়ে যায় মাইক্রোবাস
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। অন্যান্যদের মতোই মহামারি কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে টিকাদানসহ চিকিৎসা সেবায় নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে দেশের স্বাস্থ্য খাত। যার কারণে দেশে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানিও বেড়েছে।
মহামারির মধ্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের পাশাপাশি অ্যাম্বুলেন্সের আমদানি বেড়েছে দেশের কাস্টম হাউসগুলোতে। করোনাকালীন রোগীদের তাৎক্ষনিক পরিবহন সেবা দিতেই আসছে এই অ্যাম্বুলেন্সগুলো। এটি সু-সংবাদ মনে হলেও এর আড়ালে রয়েছে শুল্ক ফাঁকির গল্প।
বিজ্ঞাপন
বিদেশ থেকে আমদানি করা অ্যাম্বুলেন্সগুলো সীমান্ত পেরিয়েই হয়ে যাচ্ছে দামি মাইক্রোবাস। আর শুল্ক-কর সুবিধার কারণে গাড়ি প্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা যাচ্ছে একটি অসাধু সিন্ডিকেটের পকেটে। এতে করে একদিকে সরকার যেমন বড় অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃত গাড়ি আমদানিকারকরা মাইক্রোবাস বিক্রির বাজার হারাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিদেশ থেকে বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করা মাইক্রোবাস সিসি ভেদে প্রযোজ্য শুল্ক-কর ১৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১৬০ শতাংশ। যা অ্যাম্বুলেন্সের বেলায় মাত্র ৩২ শতাংশ। ফলে আমদানি করা ১৮০০ থেকে ২০০০ সিসি মাইক্রোবাসের দাম দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকা। বিপরীতে দিকে একই ক্যাটাগরি অ্যাম্বুলেন্সের শুল্ক-করসহ মূল্য আসে ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাইক্রোবাস অপেক্ষা অ্যাম্বুলেন্সের দাম প্রায় অর্ধেক। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে অসাধু গাড়ি আমদানিকারকরা।
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম অভিযোগ করে বলেন, দেশে এখন মাইক্রোবাস আমদানি হচ্ছে না বা কমে গেছে। সব নাকি অ্যাম্বুলেন্স আসছে। পরে এগুলো দেশে এসে মাইক্রোবাসে কনভার্ট হয়। কারা এই সুবিধার অপব্যবহার করছে এটা আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার।
আবার মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণা দিয়েও খালাস করার নজির রয়েছে। করোনা মহামারির প্রথম দিকে ২০২০ সালের জুলাই মাসে এমন একটি ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে এক হাজার ৩০০টি নোয়া ও হাইএইস মডেলের মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণায় বের নেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল। এমনকি এগুলোর মধ্যে অর্ধেকে খালাসও হয়েছিল। সে ঘটনা আর চাপা থাকেনি। অভিযোগ ছিল, গাড়ি ব্যবসায়ী সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা ও কাস্টম হাউজের দুই ডেপুটি কমিশনারের যোগসাজশে ওই চালানগুলো বের করা হয়েছিল। এর পরপরই এনবিআর এ বিষয়ের নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
এর আগের বছর (২০১৯ সালে) গাজীপুরে অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণায় আমদানি করা পাঁচটি মাইক্রোবাসের রেজিস্ট্রেশনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ৫৫টি অ্যাম্বুলেন্সের চেসিস নম্বর উল্লেখ করে এ বিষয়ে রেজিস্ট্রেশন না দিতে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেন। যদিও বিআরটিএ কি ব্যবস্থা নিয়েছিল, সে বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত কোনো জবাব পাননি বলে কাস্টম কমিশনার দাবি করেন।
এর কিছুদিন পর কমিশনার ফখরুল ইসলাম এনবিআর চেয়ারম্যান সার্বিক বিষয়ে অবগত করে চিঠি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছে, তা সঠিক কি না জানাতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের জবাব দেয়নি কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে অ্যাম্বুলেন্স আমদানিকারকদের বিবরণে বলেন- এসআই অটোমোবাইলস, টারবো অটো, এফবিটি অটোমোবাইলস, জেআর অটোমোবাইলস ও লামিয়া এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এসব মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্স দেখিয়ে আমদানি করেছিল। পাঁচটি ছাড়াও অন্য মোটরযানের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাই সুযোগের অপব্যবহার রোধে তিনি এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেওয়া চিঠিতে কয়েকটি সুপারিশ যোগ করেন।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে শুল্ককর নগদে আদায় করা, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সের পার্থক্যজনিত শুল্ককর ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে রেখে মোটরযান খালাস করা, ছয় মাসের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের দলিল দিলে ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেওয়া, এরই মধ্যে যেসব কর্মকর্তা অ্যাম্বুলেন্সকে মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা ইত্যাদি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণায় মাইক্রোবাস রেজিস্ট্রেশন হওয়াটা এক ধরনের অপরাধ ও দেশের ক্ষতি। আমরা ইতিমধ্যে কয়েকটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। এছাড়া বিআরটিএকে বিষয়টি অবগত করে রেজিস্ট্রেশন করার আগে সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসের মাধ্যমে কাগজপত্র যাচাই করার অনুরোধ করেছি। এনবিআরকে বিষয়টি অবগত করে বেশকিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে অ্যাম্বুলেন্স আমদানির বিপরীতে শুল্ক সুবিধার অপব্যবহার না হয়।
এনবিআর সূত্র বলছে, নাভানা ট্রেডিং, আকিজ মোটরস, মিরাজ কারস, গ্রীনল্যান্ড অটো, এলএনবি অটোমোবাইলস, হাবিব অ্যান্ড ব্রাদার, হাতিম করপোরেশন, এফবিটি অটোমোবাইলস, কেআরএস করপোরেশন, জারা ইন্টারন্যাশনাল, আরকে ইন্টারন্যাশনাল, আনোয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এমএন অটোমোবাইলস, আবিদ অটোমোবাইলস, ম্যাক্স পাওয়ার বাংলাদেশ, ডায়নামিক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এইচএ ট্রেডিং, এসএম অটোমোবাইলস, এনএফ এন্টারপ্রাইজ, জেঅ্যান্ডএফ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, সালসাবিল অটো, লাইমা এন্টারপ্রাইজ, আল মারজুক ট্রেডিং, বিডি ট্রেড অ্যান্ড কোম্পানি, মাফারা ইন্টারন্যাশনাল, স্টার লাইন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, হাতিম করপোরেশন সবচেয়ে বেশি অ্যাম্বুলেন্স আমদানি করে থাকে।
বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে নিবন্ধিত অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। যার মধ্যে ২০১০ পর্যন্ত নিবন্ধন নিয়েছে দুই হাজার ৭৯৩টি। বাকিগুলোর রেজিস্ট্রেশন ২০১১ সাল থেকে দেওয়া হয়েছে।
মাইক্রোবাস অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে শুল্কায়ন হয়ে বের হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ২০১৬ সালে প্রথম এনবিআরের নজরে আসে। পরে অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণায় মাইক্রোবাস শুল্কায়ন যাতে করতে না পারে, সেজন্য সব কাস্টম হাউসকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়। তবে কিছু অসাধু আমদানিকারক আর বিআরটিএ কর্মকর্তার যোগসাজশে অ্যাম্বুলেন্স মাইক্রোবাস হিসেবেই রেজিস্ট্রেশন নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিআরটিএ পরিচালক (অপারেশন ) মো. লোকমান হোসেন মোল্লাকে কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে বিআরটিএ'র অপর এক কর্মকর্তা বলেন, গাজীপুরের এক ব্যবসায়ী অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি করা দুটি মোটরযান মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছিলেন। যা নজরে আসার পর আমরা রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছি। ৭০টি পয়েন্ট থেকে রেজিস্ট্রেশন হয়ে থাকে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে আমাদের প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়।
এ বিষয়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আব্দুল হক ঢাকাপোস্টকে বলেন, করোনাকালীন অ্যাম্বুলেন্স যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা দেখছি। সরকারের উদ্যোগের কারণে অনেক কম দামে অ্যাম্বুলেন্স বাংলাদেশে এসেছে। হাজার হাজার মানুষের উপকার হয়েছে। কোনো ব্যবসায়ী যদি সরকারের শুল্ক সুবিধার অপব্যবহার করে থাকে আমাদের অবস্থান তার বিপক্ষে থাকবে। এটা একটি অপরাধ। তাদের ধরা উচিত। আমরা কোনোভাবে চাইবো না যারা প্রকৃত ব্যবসায়ী তাদের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হোক।
আরএম/এমএইচএস