লকডাউন বা বিধিনিষেধ দিয়ে দেশের করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংক্রমণ কমাতে সর্বত্র মাস্ক পরা নিশ্চিত ও ভারতীয় সীমান্তে মানুষের চলাচল বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ।

রোববার (২৫ এপ্রিল) ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে করোনার সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি এসব কথা জানান।

সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে অসীম কুমার নাথ জানান, বাংলাদেশের বেশিরভাগ শহর ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি। প্রতিদিন জীবিকার তাগিদে কাজের জন্য মানুষকে বাধ্য হয়ে বাইরে বের হতে হয়। তাই এ দেশে লকডাউন বা বিধিনিষেধ দিয়ে তেমন কোনো লাভ হবে না। কারণ এ বিধিনিষেধ কার্যকর করা সম্ভব নয়। এখন যেহেতু পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছে তাই দুটি বিষয় জোড় দিলে আমরা সুরক্ষিত থাকতে পারব।

প্রথমত- বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে বড় অংকের জরিমানা ও জেল দিয়ে হলেও এটি নিশ্চিত করতে হবে যেন বাধ্য হয়ে মাস্ক পরে। এক্ষেত্রে  শুধু সরকার-প্রশাসন নয়, মাস্ক পরার বিষয়ে জনগণকে সচেতন হতে হবে। অন্যকে সচেতন করতে হবে। কেউ যেন মাস্ক ছাড়া বাইরে ঘুরতে না পারেন, যার যার অবস্থান থেকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

একটি উদাহরণ দিয়ে মুগদা হাসপাতালের এ পরিচালক বলেন, এক সময় গণপরিবহনে বসে অনেকেই ধুমপান করতেন। এখন কেউ কি বাসে বসে ধুমপান করতে পারেন? না, কারণ কেউ ধুমপান করতে চাইলে বাসের যাত্রীরাই প্রতিবাদ করেন। এরকম সর্বত্র মাস্ক পরার বিষয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

দ্বিতীয়ত- আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও প্রতিবেশি দেশ ভারতে করোনা এখন ভয়াবহ অবস্থায় রূপ নিয়েছে। আমাদের প্রয়োজনে ভারতের মালামাল আমদানি করতে হয়। পণ্য আসুক সমস্যা নেই। কিন্তু মানুষ স্বাভাবিক নিয়মে যেন না আসতে পারেন। এখনই এ মুহূর্তে ভারতীয় সীমান্তে মানুষের চলাচল বন্ধ করতে হবে। কারো যদি একান্ত প্রয়োজনে আসতে হয়, তাকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে অবশ্যই রাখতে হবে। এটি এখনই কার্যকর করা দরকার।

মুগদা মেডিকেলের করোনার পরিস্থিতি বিষয়ে অসীম কুমার নাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। রোগীর চাপ অনেক কমেছে। মুগদা মেডিকেলে শয্যা সংখ্যা ৩০০টি ছিল। করোনার কারণে আরও ৫০টি যোগ করা হয়েছে। এছাড়া ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) শয্যা ২৯টি রয়েছে। সব মিলিয়ে শয্যা আছে ৩৭৯টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ১৮৪টিতে। এক মাস বা ২০ দিন আগেও এখানে বেড খালি থাকতো না। তার মানে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে সাধারণ বেড খালি থাকলেও আইসিইউ খালি নেই।

করোনা শনাক্তের হারও তুলনামূলক কমে গেছে। এক মাস আগে রোগীর বেশ তীব্রতা ছিল। তবে গত দুই সপ্তাহে এ হার কমে গেছে। মার্চের শেষ দিকে আমরা যে টেস্ট করতাম তার ৫০ শতাংশই পজিটিভ আসতো। এখন তা কমে ২০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। তার মানে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এখন করোনা রোগীর চাপ অনেক কম। ফলে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যস্ততাও কিছুটা কমেছে। জরুরি বিভাগে দায়িত্বে থাকা এক কর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগের তুলনায় রোগী অনেক কমে গেছে। রোগীর দীর্ঘ সিরিয়াল থাকত। রোগীর চাপে ডাক্তাররা অবসর পেতেন না। এখন রোগীর চাপ কমেছে। তবে অনেকে মুহূর্ষু রোগীর জন্য আইসিইউয়ের খোঁজ নিতে আসেন স্বজনরা। কিন্তু সাধারণ শয্যা খালি থাকলেও আইসিইউ বেড খালি নেই।

এদিকে রোগীর চাপ কম থাকায় অক্সিজেনের সিলিন্ডারের চাহিদাও কমেছে। মুগদা হাসপাতলে অক্সিজেন সরবরাহকারী স্পেক্ট্রারকর্মী আশরাফ জানান, এক মাস আগেও প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিতাম; এখন দিনে ২৫ থেকে ৩০টি দিই। অন্যান্য হাসপাতালেও চাহিদা কমেছে।

দেশের করোনা পরিস্থিতি

রোববার (২৫ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মোট মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। এ পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১১ হাজার ৫৩ জনের। এ সময় নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯২২ জন। এতে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৩২২ জনে।

ভারতে করোনা পরিস্থিতি

করোনায় ভারতের করোনার দৈনিক সংক্রমণ চিত্র গুরুতর রূপ নিচ্ছে। শনিবার (২৪ এপ্রিল) ভারতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩১৩ জন, যা বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড। আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে ভারতে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে করোনায় মারা গেছেন মোট ২ হাজার ৭৬৭ জন রোগী। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬২৪ জন।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস মহামারি ঘোষণা করে। এই ভাইরাস বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কাড়ছে। 

২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়লেও প্রায় এক বছর সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও গণসচেতনতার ফলে করোনাভাইরাস অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে এবং বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

এসআই/আরএইচ