সজিব সতেজ সঞ্জীবনী

বিশ্বজুড়ে চলছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের তাণ্ডব। প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। পরিস্থিতি ভয়াবহ। করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে মানুষ এখন অসহায়, বিশ্ব স্থবির। মহামারি করোনা থেকে ছাড় পায়নি বাংলাদেশও।

প্রতিদিনই চারপাশে শোনা যাচ্ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংবাদ। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি প্রথম দিকে স্বাভাবিক থাকলেও মাসখানেকের মধ্যে করোনাভাইরাস যেন ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ভয়াবহ এই ভাইরাস কেড়ে নিচ্ছে অসহায় মানুষের প্রাণ। করোনায় মৃত্যুর পর মৃতদেহ তো দূরের কথা আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশেও আসছিল না মানুষ। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিল কিংবা দাফন-কাফনে এগিয়ে আসছিল না স্বজনেরা। 

সজিব সতেজ সঞ্জীবনী। পেশায় নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যশিক্ষক। বেড়ে উঠেছেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন 

এমনই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সমাজের মানুষ যখন উল্টোপথে হাঁটছিল তখন মৃতের দাফন-কাফনে এগিয়ে আসেন একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। নাম তার সজিব সতেজ সঞ্জীবনী (২৬)। তিনি পেশায় একজন নৃত্যশিল্পী এবং নৃত্যশিক্ষক। বেড়ে উঠেছেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক অনুমোদিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি গত ১১ মাস যাবত দিন-রাত করে যাচ্ছেন এই কাজ। প্রথমে চট্টগ্রামে ২ মাস, তারপর ঢাকায় ৯ মাস ধরে করোনাভাইরাসে মৃত মানুষের দাফন-কাফন, সৎকার থেকে শুরু করে গোসল করানোসহ যাবতীয় কাজ তিনি নিজ হাতে করে যাচ্ছেন।

সজিব সতেজ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও দমে যাননি, মানুষের কল্যাণে বিনাস্বার্থে কাজ করে গেছেন। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তার এ কাজ শুরুর কথা, বলেছেন তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের কথাও। 

২০১৯ সালে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শুরু হয়। তখনই বাংলাদেশের কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন পরিকল্পনা করে, বাংলাদেশেও যদি করোনাভাইরাসে মৃত্যু শুরু হয় তাহলে লাশ দাফন-কাফন, সৎকারসহ গোসল করানোর মতো যাবতীয় মানবিক কাজগুলো করবে তারা। যেমন ভাবনা ঠিক তেমনই কাজ! অবশেষে যখন দেশে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শুরু হলো, তখন থেকেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন জড়িত আছে এই মানবিক কাজের মধ্যে। এরপর তারা দেশের প্রায় পাঁচটি বিভাগে এই মানবিক কার্যক্রম শুরু করে। 

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনেরই একজন সদস্য সজিব সতেজ। করোনায় মৃতের খবর এলেই সৎকারের জন্য ছুটে গেছেন 

সজিব সতেজ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনেরই একজন সদস্য। তিনি পার্বত্য জেলা বান্দরবানে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের নাচ শেখাতেন।  যখন ফাউন্ডেশনটি তাদের মানবিক কাজ আরম্ভ করে তখন থেকেই এই মানবিক কাজে যুক্ত হন ট্রান্সজেন্ডার সজিব সতেজ।

প্রথমে তিনি মাত্র ৫ জন সদস্যের দলে নিযুক্ত হন। সজিব সতেজ শুধুমাত্র করোনায় আক্রান্ত মানুষের মৃতদেহ দাফন, গোসল করানো থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করার জন্য সুদূর বান্দরবান থেকে ছুটে আসেন চট্টগ্রামে।

তারপর থেকেই শুরু হয় তার করোনাভাইরাসের সাথে বসবাস। দিন নেই রাত নেই যখনই করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেছেন বলে খবর এসেছে, তখনই সে মানুষটির দাফন, সৎকার, গোসল করানোর জন্য তিনি তার সদস্যদের নিয়ে ছুটে গেছেন বিভিন্ন প্রান্তে।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের জন্য এসব কাজ করা সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কাছে মানুষের সেবা করাটাই সবচেয়ে উত্তম কাজ, আমি চাই আমার যা কিছুই হোক না কেন আমি সবসময় মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকব। আমি যখন মানুষের জন্য কিছু করতে পারি তখন আমার প্রাণটা খুশিতে ভরে যায়, নিজেকে নিয়ে তখন গর্ববোধ করি। আর মনে মনে বলি, আমরাও মানুষ আমরাও একে অন্যের জন্য অনেক কিছুই করতে পারি। 

এ পর্যন্ত তিনি তিন শতাধিক করোনায় মৃত মানুষের দাফন, সৎকার ও গোসল করিয়েছেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান। করোনায় মারা যাওয়াদের লাশের সঙ্গে কাটানো সময় সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দেখেছি, করোনায় মৃত অনেকের আত্নীয়-স্বজনরা লাশের আশপাশেও আসেননি। তখন আমরাই ছিলাম সেই লাশগুলোর সব থেকে আপন সঙ্গী। তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি যেন আমার আপন মানুষকে সঙ্গ দিচ্ছি, তার সুখ-দুঃখের কাঙ্গাল আমি। এ মুহূর্তগুলো আমি কখনই ভুলব না।

প্রথমে সজিব সতেজ চট্টগ্রামে দু’মাস কাজ করেছেন। তারপর চলে এসেছেন ঢাকায়। ঢাকায় আসার পর ন’মাস ধরে যুক্ত আছেন এই কাজে।

তিনি ঢাকার সেগুনবাগিচায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ক্যাম্পে থেকে এসব কাজ করে যাচ্ছেন। ক্যাম্পে থাকা অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা শহরের অলি গলি হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করছেন করোনায় মৃতদের মরদেহ। তারপর নির্দিষ্ট কবরস্থান অথবা শ্মশানে নিয়ে তাদের জন্য করে যাচ্ছেন ‘শেষ কাজ’টুকু।

করোনাভাইরাসে ভয়াবহতার মধ্যে থেকেও তিনি যখন এসব কাজ করছেন, তখন এসব কাজে তার পরিবারের নিরবচ্ছিন্ন উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছেন জানিয়ে ঢাকা পোস্টকে তিনি আরও বলেন, “আমার পরিবার আমার সকল কাজকর্মে ছোটবেলা থেকেই অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছেন। তাই এসব কাজও আমি আমার পরিবারের অনুমতি নিয়েই করছি এবং তারা আমাকে উৎসাহও দিচ্ছেন”। 

২৬ বছরের অজস্র নিপীড়নের ঘটনা রয়েছে তার। জানিয়েছেন ঢাকা পোস্টকে

অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডারদের মতো তিনিও হয়েছেন নিগৃহীত। তার জীবনেও আছে নিপীড়িত-নিগৃহীত হওয়ার গল্প। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরে অজস্র ঘটনা রয়েছে তার। দুয়েকটি ঘটনা জানিয়েছেন ঢাকা পোস্টকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ‘অঙ্গন’ ও ‘প্রথম আলো’ বন্ধু সভার সক্রিয় সদস্য ছিলেন। উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে নৃত্যে দর্শক মাতিয়েছেন। ‘সজিব সতেজ’ নামে একটি নৃত্যগোষ্ঠীও ছিল তার। মঞ্চে নাচ করতেন প্রায় সময়। মঞ্চে পারফর্ম করতে উঠে বা পারফর্ম করে ফেরার পথে রাস্তায় ছেলেদের উত্যক্তের শিকার হতেন তিনি। এমনকি শরীরের কাপড় খুলে নেয়ার চেষ্টার মতো ঘটনাও ঘটেছে তার সাথে। 

হত্যার হুমকি পেয়েছেন বহুবার। তবে দমে যাননি 

চবির আলাওল হলে থাকাকালীন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য একটি ইসলামিক ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের কাছ থেকে খুন-জখমের হুমকিও পেয়েছেন বহুবার। তবুও তিনি দমে যাননি। শুধু বাইরে নয়, শ্রেণিকক্ষেও উত্যক্তের শিকার ছিলেন তিনি। ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার কারণে ক্লাসের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা ও মজা করত।

পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই সরাসরি সামনে এসে খারাপ মন্তব্য করত। সবকিছুই হাসিমুখে মেনে নিতেন তিনি। এতসব খারাপ স্মৃতির মধ্যে ভালো স্মৃতিও রয়েছে তার। ২০১৩ সালে ভর্তির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের শিক্ষকের ভালোবাসা ছিল তার প্রতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বড় ভাইরাও ছিল তার প্রতি সহানুভূতিশীল।

সমাজের কুসংস্কার ও অচলায়তন ভেঙে ট্রান্সজেন্ডার নারীরা দীপ্ত পায়ে হাঁটি হাঁটি পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাসনুভা আনান শিশির, হোচিমিন ইসলামসহ নাম না জানা এমনি অনেকের অংশগ্রহণে সমাজ যখন স্বাভাবিকতার পথে হাঁটছে তখন মানুষ-মানবতার কল্যাণে নিবেদিত জান বাজি রাখা সজিব সতেজের করোনায় মৃতদের জন্য নজিরবিহীন এই আত্মত্যাগ মনে রাখার মতো।

সজিব সতেজদের মানবতার এমন দরদি হাত ধরেই নতুন সমাজ বিনির্মাণ হোক, ঘুরে দাঁড়াক আমাদের প্রিয় এই স্বদেশ।

এইচকে