প্রতীকী ছবি

বিশ্বের অনেক বড় শহরের মতো আবাসন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে রাজধানী ঢাকায়। চাকরি-কাজের সন্ধানে, শিক্ষা বা নাগরিক সুবিধার প্রয়োজনে ঢাকামুখী হওয়া এর মূল কারণ মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে ঢাকায় বাসযোগ্য স্থানের সংখ্যা দিন দিন কমছে। আবার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান ও যথাযথ নাগরিক ‍সুবিধা পাওয়া একটি চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে ঢাকার অদূরে পরিকল্পিত আবাসিক প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

জানা গেছে, আবাসন খাতের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় কেরানীগঞ্জ মডেল টাউনে এ প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ২ হাজার ৫০০ একর (কম-বেশি) জমিতে প্রকল্প সীমানা প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মহানগরীর সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ২০০ ফুট প্রশস্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১২০ ফুট প্রশস্ত প্রায় ১.৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি সংযোগ সড়কের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। অগ্রগতি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করেছে রাজউক। এরপর এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সব ঠিক থাকলে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

কেরানীগঞ্জে এমন প্রকল্প কেন- জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে কেরানীগঞ্জ এলাকাটি অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। অথচ ঢাকার অদূরে এই এলাকাটি পর্যাপ্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভৌত অবকাঠামোর সমন্বয়ে ঢাকা শহরের বিকেন্দ্রীকরণের একটি আদর্শ এলাকা হতে পারে।

তাদের মতে, এখানে আধুনিক নাগরিক সুবিধা সম্বলিত আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলা হবে। ফলে তা ঢাকার আবাসন, কর্মসংস্থান ও নাগরিক খাতের সমস্যাগুলো লাঘবের একটি কার্যকরী উদ্যোগ হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ঢাকার কেরানীগঞ্জের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পে জনসংখ্যার অনুপাতে ও নগর পরিকল্পনার দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিক সুবিধার প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। এছাড়া বয়োবৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য প্রকল্পে প্রায় ২০ বিঘা (৬.৬১) একর আয়তনের অ্যাসিস্ট্যান্ট লিভিং জোনের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা ম্যাপ /ছবি- সংগৃহীত

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নির্বাচনী ইশতেহারের অংশ হিসেবে ও রাজউকের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন প্রকল্পে কৃষিভিত্তিক নগরায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে মোট প্রকল্প এলাকার একটি নির্দিষ্ট অংশ কৃষিজমি, কৃষিভিত্তিক শিল্প প্লট ও ইকো ট্যুরিজম এলাকা হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে। প্রকল্পের আওতায় সংরক্ষিত কৃষিজমি রাজউক থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য লিজ দেওয়া হবে। এই কৃষি জমিগুলো যাতে অন্য কোনো কাজে ব্যবহৃত না হয় সে বিষয়টি রাজউক তদারকি করবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষকরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন।

এছাড়া প্রস্তাবিত ২ হাজার ৫০০ একর প্রকল্প এলাকার মধ্যে আনুমানিক ২০০ একর এলাকা নিয়ে ল্যান্ড রিডজাস্টমেন্ট জোন অ্যান্ড লো ইনকাম হাউজিং-এর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে প্রকল্প এলাকায় বসবাসকারী ও কৃষকদের প্রকল্পে পুনর্বাসনের সুযোগ হবে। ফলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগণের আবাসনের ব্যবস্থা হবে। কৃষিবান্ধব নগরায়ন, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ ও জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০২১ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ্য হওয়ায় রাজউকের এ ধরনের মৌলিক উদ্যোগ ঢাকা মহানগরীর আবাসন সংকট হ্রাসের পাশাপাশি ক্রমহ্রাসমান কৃষিভূমি রক্ষায় একটি বড় পদক্ষেপ হবে। 

প্রকল্পে জনসংখ্যার অনুপাতে ও নগর পরিকল্পনার দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিক সুবিধার প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। এছাড়া বয়োবৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য প্রায় ২০ বিঘা (৬.৬১) একর আয়তনের অ্যাসিস্ট্যান্ট লিভিং জোনের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। 

কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন বিষয়ে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) পরিচালক আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অগ্রগতি পুনর্গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। এখন আমরা গৃহায়ন ও গণপূর্তে পাঠিয়ে দেব যেন প্ল্যানিং কমিশনে এটি পাঠানো হয়। প্রকল্পের কাজ আরও আগেই শুরু হতো। করোনার কারণে কিছুটা ধীরগতি হয়েছে।

এটি গতানুগতিক হাউজিং প্রকল্প নয় উল্লেখ করে এ পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, পাবলিক স্পেসকে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের জন্য ব্লক কনসেপ্ট ক্রিয়েট করা হয়েছে। কৃষিভিত্তিক নগরায়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকার বায়ো ডাইভারসিটি, পরিবেশগত দিক বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

ড্যাপ পরিচালক বলেন, কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন প্রকল্পে গ্রামীণ ও শহুরে পরিবেশের সংমিশ্রণ থাকবে। প্রকল্পের জন্য কোনো বসতিকে আমরা অধিগ্রহণ করছি না। বলতে গেলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য এ প্রকল্প। কারণ এটা কৃষিভিত্তিক একটি প্রকল্প। অর্থাৎ শহরের উচ্চবিত্ত মানুষরা তো আর কৃষিভিত্তিক শহরে যাবে না। কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানার জন্য এখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লট করা হবে। কেউ এখানে ডেইরি ফার্ম করবে বা কেউ ফুড প্রসেসিং করবে। আমার গ্রাম আমার শহর এ কনসেপ্ট থেকে ইনোভেটিভ ফর্মে এখানে এ প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, মূলত আমাদের পরিবেশগত বা ইকোলজিক্যাল দিক প্রাধান্য দিয়ে এই প্রকল্পের ডিজাইন করা হয়েছে। বর্তমানে এটি পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। সব ঠিক থাকলে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এর কাজ পুরোপুরি শেষ হবে। 

কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন প্রকল্পটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন হবে। আর এটি বাস্তবায়ন করবে রাজউক।প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিকল্পিত বসবাসের সংস্থান করে ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ কমানো এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া যথাযথ নগরায়নের মাধ্যমে ঢাকা শহরের পরিবেশগত ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা হবে। যেন সব নাগরিক সুবিধার সমন্বয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দূষণমুক্ত আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলা যায়। এর মাধ্যমে ঢাকার ক্রমবর্ধমান আবাসন ও বাণিজ্যিক চাহিদা মেটানো হবে।

অন্যদিকে কেরানীগঞ্জ এলাকায় আধুনিক নাগরিক সুবিধা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম তথা নতুন শহরের বিস্তার ঘটানো যাবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রকল্পের আওতায় কৃষিভূমি সংরক্ষণ করে খাদ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পগুলোর প্রসার ঘটানোর চেষ্টা থাকবে, বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।

এএসএস/ওএফ/জেডএস