করোনামুক্তি ও ফিলিস্তিনিদের হেফাজতে প্রার্থনা
বৈশ্বিক করোনাভাইরাস ও সরকারি বিধিনিষেধের মধ্যে সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। শুক্রবার (১৪ মে) সকালে ঈদের নামাজ আদায় করলেও ঐতিহ্য অনুযায়ী নামাজের পর কোলাকুলি ও হাত মেলানি মুসলমানরা। মহামারির কারণে এবারও মানুষের মাঝে ঈদের সেই চিরাচরিত আমেজ না থাকলেও এ দুঃসময়ে ঈদ যেন মানুষের মনে আনন্দ বারতা নিয়ে এসেছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতদের জন্য দোয়া করা হয়। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীকে এ করোনা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করা হয়। দেশ, জাতি ও মুসলিম মিল্লাতের বিশেষ করে ফিলিস্তিন, চীনের উইঘুরসহ বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের হেফাজতের জন্য দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। বালা মুসিবত থেকে সবার সুরক্ষা কামনা করে দেশ ও জাতির সুখ-শান্তি এবং সমৃদ্ধির জন্য মসজিদে মসজিদে মোনাজাত করা হয়।
বিজ্ঞাপন
করোনা মোকাবিলায় ও সংক্রমণ বিস্তার রোধে সরকারের নির্দেশনায় এবার খোলা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি। সারাদেশের ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় মসজিদের ভেতরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে।
রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ তার পরিবারের সদস্য এবং কয়েকজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনের দরবার হলে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছেন। সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে ঈদের নামাজ আদায় করেন তিনি।
নামাজ শেষে এক ভিডিও বার্তায় দেশবাসীকে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ঈদের আনন্দঘন দিনে আমি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রতি বছর হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাত হলেও করোনার কারণে এবার হয়নি। শত বছরের ঐতিহ্য ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানের ঈদ জামাতও এবার অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ঈদের ৫টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের প্রধান জামাত এবার বায়তুল মোকাররম মসজিদেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রত্যেকটি জামাতেই মসজিদে মুসল্লিদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। প্রত্যেকটি জামাত চলার সময় বিপুল সংখ্যক মানুষকে মসজিদের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। মসজিদে জায়গা না পেয়ে দক্ষিণ গেটের বাইরে স্টেডিয়ামের সামনের সড়কে অনেককে নামাজে অংশ নিতে দেখা গেছে।
বায়তুল মোকাররমে প্রত্যেকটি জামাতেই দক্ষিণ গেট দিয়ে মুসল্লিদের সারি ধরে আর্চওয়ে দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। মসজিদের গেটে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে হাত ধোয়া ও হ্যান্ড সেনিটাইজারের ব্যবস্থা ছিল। যাদের মুখে মাস্ক ছিল না মসজিদ কর্তৃপক্ষ এসব মুসল্লিদের মাঝে মাস্ক বিতরণ করা হয়।
প্রতিটি জামাত ও খুতবাহ শেষে মোনাজাতের সময় আবেগে আপ্লুত মুসল্লিরা চোখের পানিতে গুনাহ থেকে আল্লাহর কাছে মাফ চান। করোনা দূর করে স্বাভাবিক জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে আর্জি জানান তারা। মোনাজাতে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ কামনা করা হয়। তবে ঈদের নামাজ শেষে মুসল্লিদের কোলাকুলি ও হাত মেলানোর চিরাচরিত চিত্র চোখে পড়েনি।
বায়তুল মোকাররমে নামাজ শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেন, ঢাকা থেকে যারা প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে বিভিন্ন জেলায় গেছেন তাদের সরকারি বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের আগে ঢাকায় না ফেরার অনুরোধ করছি।
সকাল ৯টায় জামাত আদায় করে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, এইদিনে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর যে হামলা হচ্ছে তা যেন বন্ধ হয়ে যায়, যেন শান্তি ফিরে আসে। পাশাপাশি আমি এই হামলার নিন্দা জানাই।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ৩টি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৮টায়। এরপর আরও দুইটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জামাতে নামাজ আদায় করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ।
রাজধানীর গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদে সকালে ৩টি, পুরান ঢাকার চকবাজার শাহী মসজিদে ২টি, বড় কাটারা মাদরাসা মসজিদ ও লালবাগ শাহী মসজিদে একটি করে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
মহাখালীর মসজিদে গাউসুল আজমে তিনটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং শহীদুল্লাহ হল জামে মসজিদে সকাল সাড়ে ৮টায় একটি ঈদ জামাত হয়। আজিমপুর কবরস্থান মসজিদে চারটি, মিরপুর দারুস সালাম লালকুঠি বড় মসজিদে একটি, পুরান ঢাকা তারা মসজিদে ২টি, রায়সাহেব বাজার জামে মসজিদে একটি, নিমতলী ছাতা মসজিদে দুটি, আগামছি লেন জামে মসজিদে ২টি এবং বায়তুল মামুর জামে মসজিদে দুটি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
বন্দর নগর চট্টগ্রাম নগরের মসজিদে মসজিদে সকালে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৮টায় চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে। দ্বিতীয় জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল নয়টায়। জমিয়াতুল ফালাহ ছাড়া নগরের সুগন্ধা আবাসিক এলাকা জামে মসজিদ, হজরত শেখ ফরিদ (র.) চশমা ঈদগাহ মসজিদ, চকবাজার সিটি করপোরেশন জামে মসজিদ ও মা আয়েশা সিদ্দিকী চসিক জামে মসজিদে (সাগরিকা জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়াম সংলগ্ন) ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে একটি করে প্রধান ঈদ জামাত নিজ নিজ মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়।
ঈদ উপলক্ষে আলাদা বাণীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল (বৃহস্পতিবার) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সবাইকে বর্তমান অবস্থানে থেকেই স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে ঈদুল ফিতর উদযাপন করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা ঈদ উদযাপন করব। তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে। কোনোভাবেই এই ঈদ উদযাপন যাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার উপলক্ষ হয়ে না ওঠে, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’
এদিকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ঢাকায় বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিক ও মিশনপ্রধানরা। তারা সেদেশে সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈদের শুভেচ্ছা জানান। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী, ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট ডিকশন, ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
ছিল না চিরাচরিত কোলাকুলি করমর্দন
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরে এবারও ছিল না চিরাচরিত কোলাকুলি ও হাত মেলানোর দৃশ্য। জামাত শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়া মুসল্লিদের আনন্দ ভাগাভাগির চিরাচরিত দৃশ্য এবারও ছিল অনুপস্থিত। হাত মেলানো ও কোলাকুলির মতো সংস্পর্শ নিষিদ্ধ থাকায় অতৃপ্তির কথা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
আক্ষেপ করে মুসল্লিরা বলেন, অনেক দিন পর ঈদ জামাতে পরিচিত ও প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা হলেও কোলাকুলি তো দূরের কথা হাত পর্যন্ত মেলাতে পারেনি। আবার কবে যে ফিরে আসবে স্বাভাবিক সেই দৃশ্য! আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করেছি যেন দ্রুত এ দুর্ভোগ থেকে আমাদের মুক্তি দেন। মানুষ যেন আবার স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে পারে।
রাজধানীর গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদে ঈদের জামাত শেষে এমন আক্ষেপের কথা বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অনেক বছর পর দেশে ঈদ করতে এসেছি। ঈদের জামাতে পুরানো অনেক পরিচিত মুখ ও প্রিয়জনদের কাছে পেয়েও কোলাকুলি তো দূরের থাক হাতও মেলাতে পারেনি। কোলাকুলি করতে পারছি না, এর জন্য কষ্ট হচ্ছে।
দুই ছেলে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে এসেছেন মুশকায়েত রহমান। ঈদ জামাতে এসে স্কুলের সহপাঠীদের পেয়ে বেজায় খুশি তার সন্তান। অনেকটা এগিয়ে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি করতে গেলেও বাধা আসে বাবাদের পক্ষ থেকে। বলা হয়, এখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলছে, কোলাকুলি করা যাবে না।
আক্ষেপ করে মুশফিকুর রহমান বলেন, অন্যবার ঈদের দিন ছেলেরা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে কত হইহুল্লোড় করে, আমরাও ছোটবেলা তাই করে বেড়িয়েছি। কিন্তু দুই বছর ধরে এগুলো হচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের বাসায় দাওয়াত খেতে যাব, সেই সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতির ঈদের আসল যে আনন্দ, সেটি অনুপস্থিত।
ছেলে রাকিবকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে এসেছিলেন শাহজাহান। তার কণ্ঠেও একই সুর। ঈদের জামাত শেষে প্রথমে ছেলের সঙ্গে কোলাকুলি করতাম। পরে আব্বুর সঙ্গে। এরপর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত জনদের সঙ্গে। এবার তা করতে পারলাম না। তাই মন খারাপ।
এনএম/এইচকে