মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়িয়ে যাচ্ছেন এসব শ্রমিক, ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানির দেশ। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে মূল অবদান রাখছে প্রবাসীদের আয়। করোনা মহামারির সংকটের মধ্যেও বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে দুই হাজার ১৭৪ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি যাদের উপার্জনে আজ শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে, তারাই আজ বঞ্চিত হচ্ছেন সবক্ষেত্রে।

একজন পুরুষের বিদেশে যেতে খরচ হয় চার লাখ ৭১ হাজার ৬৬৭ টাকা। প্রবাসে যাওয়ার পর প্রত্যেক পুরুষ কর্মী গড়ে মাসিক আয় করেন ২৪ হাজার ৬৭৩ টাকা। বিদেশে যাওয়ার পর খরচের টাকা তুলতে ১৯ দশমিক এক মাস কাজ করতে হয় তাকে। অন্যদিকে, একজন নারীর প্রবাসে যেতে খরচ হয় এক লাখ ১০২ টাকা এবং তাদের মাসিক গড় আয় ১৮ হাজার ৩৩ টাকা।

আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অথবা কোনো এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এক ঝুড়ি স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিদেশে পাড়ি দেন একজন শ্রমিক। জনপ্রতি খরচ হয় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি। অথচ ভিনদেশে পাড়ি জমিয়ে খরচের টাকা তুলতেই পার হয়ে যায় প্রায় দেড় বছর (১৭ দশমিক ৬ মাস)। হৃদয়ে রাখা স্বপ্নের ফানুস কখন যে উবে যায় তা তিনি উপলব্ধিই করতে পারেন না। কারণ প্রবাসে একজন কর্মী মাসে গড়ে আয় করেন মাত্র ২৩ হাজার ৬৯৩ টাকা। অথচ বিদেশে আসতেই তার ঘাড়ে ঋণের বোঝা প্রায় পাঁচ লাখ টাকার।

সম্প্রতি অভিবাসন বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো চালানো একটি জরিপের তথ্য প্রকাশ করে। জরিপটি মূলত শ্রম অভিবাসীদের নিয়োগ ব্যয় এবং তাদের মাসিক আয় সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর করা। জরিপটির মাধ্যমে অভিবাসীদের আর্থ-সামাজিক ও জনমিতিক অবস্থা, অভিবাসীদের বৃত্তান্ত, নিয়োগ ব্যয়, অর্থের উৎস, ঋণ/ধার ও পরিশোধ, মাসিক আয় ও লিঙ্গ, বয়সভিত্তিক শ্রেণিবিভাজন, শিক্ষা সম্পন্নের স্তর, দক্ষতার ধরন এবং প্রধান গন্তব্য দেশসহ প্রভৃতি তথ্য উঠে এসেছে।

সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কোনো বক্তব্য দিতে পারি না। যদি আমাদের মহাপরিচালক (ডিজি) লিখিতভাবে নির্দেশ দেন তাহলে এ বিষয়ে কথা বলতে পারব। এর বাইরে অফিসে আসলে টেকনিক্যাল কিছু বিষয়ে বলতে পারব

কবির উদ্দিন আহমেদ, জরিপ ২০২০– এর প্রকল্প পরিচালক

জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, একজন পুরুষের বিদেশে যেতে খরচ হয় চার লাখ ৭১ হাজার ৬৬৭ টাকা। প্রবাসে যাওয়ার পর প্রত্যেক পুরুষকর্মী গড়ে মাসিক আয় করেন ২৪ হাজার ৬৭৩ টাকা। বিদেশে যাওয়ার পর খরচের টাকা তুলতে ১৯ দশমিক এক মাস কাজ করতে হয় তাকে। অন্যদিকে, একজন নারীর প্রবাসে যেতে খরচ হয় এক লাখ ১০২ টাকা এবং তাদের মাসিক গড় আয় ১৮ হাজার ৩৩ টাকা।

একঝাঁক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন বাংলাদেশিকর্মীরা, ছবি : সংগৃহীত 

অন্যদিকে, একজন দক্ষ শ্রমিকের বিদেশে যেতে লাগে চার লাখ ২৭ হাজার ২১৭ টাকা। মাসে তার গড় আয় ২৯ হাজার ৪৭৭ টাকা। বিদেশে যাওয়ার পর খরচের টাকা তুলতে তার ১৪ দশমিক পাঁচ মাস সময় লাগে। অদক্ষ শ্রমিকের বিদেশে যেতে লাগে চার লাখ ৭৭ হাজার ৯২৭ টাকা। মাসে তার গড় আয় ২৩ হাজার ৬২৯ টাকা। বিদেশে যাওয়ার খরচ তুলতে অদক্ষ শ্রমিককে কাজ করতে হয় ২০ দশমিক দুই মাস।

কোন দেশে যেতে কত টাকা খরচ

পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে একজন কর্মীকে সিঙ্গাপুরে যেতে খরচ হয় পাঁচ লাখ ৭৪ হাজার ২৪১ টাকা। দেশটিতে একজন কর্মী মাসে আয় করেন গড়ে ৩৮ হাজার ১২৯ টাকা। সৌদি আরব যেতে একজন কর্মীকে খরচ করতে হয় চার লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৬ টাকা। দেশটিতে একজন কর্মী মাসে আয় করেন গড়ে ২২ হাজার ১৪০ টাকা। মালয়েশিয়ায় যেতে খরচ হয় চার লাখ চার হাজার ৪৪৮ টাকা। সেখানে একজন কর্মী আয় করেন ২৩ হাজার ৮৯৬ টাকা।

বাংলাদেশ থেকে একজন কর্মীকে সিঙ্গাপুরে যেতে খরচ হয় পাঁচ লাখ ৭৪ হাজার ২৪১ টাকা। দেশটিতে একজন কর্মী মাসে আয় করেন গড়ে ৩৮ হাজার ১২৯ টাকা। সৌদি আরব যেতে একজন কর্মীকে খরচ করতে হয় চার লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৬ টাকা। দেশটিতে একজন কর্মী মাসে আয় করেন গড়ে ২২ হাজার ১৪০ টাকা। মালয়েশিয়ায় যেতে খরচ হয় চার লাখ চার হাজার ৪৪৮ টাকা। সেখানে একজন কর্মী আয় করেন ২৩ হাজার ৮৯৬ টাকা।

কাতারে যেতে খরচ হয় চার লাখ দুই হাজার ৪৭৮ টাকা। দেশটিতে একজন কর্মীর আয় ২২ হাজার ২৯৩ টাকা। ওমানে যেতে খরচ হয় তিন লাখ আট হাজার ৪৭ টাকা। সেখানে কর্মীরা মাসে আয় করেন ১৯ হাজার ১৭৭ টাকা। অন্যান্য দেশে যেতে চার লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৯ টাকা খরচ হয়। সেসব দেশে গড়ে মাসিক আয় ২৬ হাজার ৬১ টাকা।

সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের বালাই নেই

বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে মোট ব্যয়ের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের কোনো মিল নেই। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, অভিবাসনে সিঙ্গাপুর যেতে সরকার খরচ নির্ধারণ করে দিয়েছে দুই লাখ ৬২ হাজার ২৭০ টাকা, সৌদি আরবে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এছাড়া মালয়েশিয়ায় যেতে এক লাখ ৬০ হাজার, লিবিয়ায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৭৮০ টাকা, বাহরাইনে ৯৭ হাজার ৭৮০ টাকা, ওমানে এক লাখ ৭৮০ টাকা এবং কাতারে এক লাখ ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করা রয়েছে।

বিদেশে পা রাখার পর স্বপ্নের ফানুস উবে যায় তাদের, ছবি : সংগৃহীত Caption

এখনও প্রতি বছর একটি বড়সংখ্যক জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় স্বল্পমেয়াদের কাজে নিয়োজিত হয়ে প্রবাসে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রথম অভিবাসন কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। ছয় হাজার ৭৮ কর্মীর অভিবাসনের মধ্য দিয়ে এ যাত্রা শুরু হয়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ২২ লাখ বাংলাদেশি কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। বাংলাদেশিকর্মীরা প্রধানত স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে কাজ করেন, ফলে মেয়াদ শেষে তাদের দেশে ফিরে আসতে হয়।

এতদিন বলা হতো সরকারিভাবে কম টাকায় বিদেশে যাওয়া যায়। একথা যে সত্য নয়, সেটি জরিপের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। একজন লোক এত টাকা খরচ করে বিদেশ যান কিন্তু দেখা যায়, খরচের টাকা তুলতেই তার ভিসার মেয়াদ বা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি দেশে আসার সময় খালি হাতেই ফেরেন

শরিফুল হাসান, ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান

জরিপে আরও উঠে আসে, বর্তমানে মেয়াদশেষে দেশে ফিরে আসা কর্মীদের বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা নেই। ফলে ঠিক কতজন বাংলাদেশি দেশের বাইরে কাজ করছেন, তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। সাধারণত ধারণা করা হয়, বর্তমানে প্রায় ৮৫ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৭ লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ মানুষ মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াতে অভিবাসী হয়েছেন। বাহরাইন, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর— এই দেশগুলোতে বেশিরভাগ বাংলাদেশি বাস করেন।

অভিবাসন ব্যয় প্রসঙ্গে জরিপ ২০২০– এর প্রকল্প পরিচালক কবির উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কোনো বক্তব্য দিতে পারি না। যদি আমাদের মহাপরিচালক (ডিজি) লিখিতভাবে নির্দেশ দেন তাহলে এ বিষয়ে কথা বলতে পারব। এর বাইরে অফিসে আসলে টেকনিক্যাল কিছু বিষয়ে বলতে পারব।’

এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘এতদিন বলা হতো সরকারিভাবে কম টাকায় বিদেশে যাওয়া যায়। একথা যে সত্য নয়, সেটি জরিপের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। একজন লোক এত টাকা খরচ করে বিদেশ যান কিন্তু দেখা যায়, খরচের টাকা তুলতেই তার ভিসার মেয়াদ বা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি দেশে আসার সময় খালি হাতেই ফেরেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এত টাকা খরচের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে মিডল ম্যান (মধ্যস্থতাকারী)। মিডল ম্যান বেশি থাকায় ভিসা প্রসেসিংয়ে টাকা বেশি খরচ হয়। জরিপের ফলাফল সরকার ডকুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বিদেশে গমনেচ্ছুদের ফি নির্ধারণ করতে পারবে। আমাদেরও প্রত্যাশা, বিদেশে যাওয়া কর্মীদের খরচ আরও কমবে। এটি হলে তারা লাভবান হবেন।’

এসআর/এফআর