মহাখালীর সাততলা বস্তিতে দুই সন্তান, স্ত্রী আর মাকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন নূর মোহাম্মদ মিন্টু। পেশায় ছিলেন কাপড় বিক্রেতা, বস্তি এলাকার রাস্তার পাশেই বসে লুঙ্গি, জামা-কাপড় বিক্রি করতেন। বেচা বিক্রি শেষে তার অস্থায়ী দোকানের মালামাল সাততলা বস্তির যে ঘরে তিনি বসবাস করতেন সেখানেই এনে রাখতেন। অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করে কোনোমতে সংসার চলে যেত তার।

কিন্তু সোমবারের (৭ জুন) আগুন অন্য সবকিছুর সঙ্গে স্বপ্নও পুড়ে ছাই করে দিয়েছে নূর মোহাম্মদের। এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই, সব হারিয়ে তিনি আজ নিঃস্ব। আড়াই ঘণ্টার আগুন জীবন সংগ্রামের সব অর্জনই শেষ করে দিয়ে গেছে তার। সব হারিয়ে কাপড়ের দোকানদার নূর মোহাম্মদ এখন কীভাবে সামাল দেবেন- এমন অনিশ্চয়তায় রিকশা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর রিকশা চালিয়ে যে আয় হবে তা দিয়ে আপাতত পরিবার নিয়ে তিন বেলা দু'মুঠো ভাত খাওয়ার প্রত্যাশা করছেন।

আগুনে পুড়ে যাওয়ার একদিন পর মঙ্গলবার (৮ জুন) মহাখালীর সাততলা বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, বস্তিবাসীর অনেকের রাত কাটছে খোলা আকাশের নিচে। অসহায় মানুষগুলো তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরের টিন খুলে ফেলেছেন, বস্তির চারপাশে এখনও অনেক জায়গায় পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া ঘরের টিন আর বাঁশ। আসবাব পুড়ে পড়ে আছে ছাই। বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নিজ নিজ ঘরের জায়গায় কোদাল দিয়ে ছাই সরাচ্ছে। ব্যবহারের জিনিসগুলোর মধ্যে কোনো কিছু ভালো আছে কি না সেসব দেখে আলাদা করছেন। অনেকে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে শুয়ে আছেন। আবার মাথার ওপর পর্দা দিয়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন এখানে।

এরইমধ্যে দেখা গেল একজন পুড়ে যাওয়া জিনিসগুলো হাতরাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন, তার পাশেই পলিথিন টানিয়ে শুয়ে আছেন তার পরিবারের অন্য সদস্যরা। পুড়ে যাওয়া জিনিসগুলো হাত দিয়ে ধরে কান্না করা ব্যক্তিটিই নূর মোহাম্মদ মিন্টু।

কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কিচ্ছু নাই, সব পুড়ে শেষ। বস্তির ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেনি। গতকাল পর্যন্ত ছিলাম কাপড়ের দোকনদার, কিন্তু আজ আমি নিঃস্ব। কোনো টাকা নেই, সম্বল নেই…. পরিবারে মা, স্ত্রী আর দুই সন্তান আছে, তাদের কী খাওয়াব, কীভাবে চলব। যেহেতু নিঃস্ব হয়ে গেছি তাই আগামীকাল থেকে রিকশা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জমা-খরচে রিকশা নিয়ে কাল থেকে এই এলাকাতেই রিকশা চালাব।'

তিনি বলেন, সারাদিন দোকানদারি করে সেই সব মালামাল ঘরে এনে রেখেছিলাম। যেহেতু রাস্তায় বসে কাপড়ের দোকান করি তাই দিন শেষে সব মালামাল ঘরে এনেই রাখি। ৩৬ হাজার টাকার লুঙ্গি, থ্রি পিস ছিল সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এছাড়া নগদ টাকাও ছিল, কিচ্ছু নিতে পারিনি, সব শেষ হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়েই রিকশা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রিকশার বিষয়ে কথা বলেছি গ্যারেজে। কাল থেকে নতুন পেশা শুরু করব। 

সিটি করপোরেশনের নগদ অর্থ, ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ

বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা নগদ, খাদ্যসামগ্রী, ত্রাণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে। ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার (৮ জুন) মহাখালীর সাততলা বস্তি সংলগ্ন আইপি এইচ স্কুল অ্যান্ড স্কুল মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে নগদ নগদ টাকা এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম।

কিন্তু এরপর বস্তিতে এসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হলে তাদের অনেকেই অভিযোগ করেন অগ্নিকাণ্ডে তারা ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু নগদ অর্থ, খাদ্যসামগ্রী বা ত্রাণের কিছুই পাননি। কাপড়ের সেই দোকানদার নূর মোহাম্মদ মিন্টু বলেন, ত্রাণ বিতরণ হবে জেনে সকাল থেকে কিছু না খেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু নগদ যে ৫ হাজার টাকা, খাদ্যদ্রব্য ত্রাণ কিছুই পাইনি। অথচ আমাদের তালিকা তারা ঠিকই করেছিল।

নূরুজ্জামান আহমেদ নামের আরেক ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী বলেন, আমি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করি, বস্তিতে আগুনে আমার সব শেষ হয়ে গেছে, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু ত্রাণের মাল, টাকা যেসব বিতরণ করা হয়েছে এগুলো আমরা কিছুই পাইনি।

আসমা খাতুন নামের এক বস্তিবাসী বলেন, আমি মেসে রান্নার কাজ করি। ত্রাণের জন্য সকাল থেকে স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে থাকার পরও কিছুই পাইনি। নামের তালিকা করে গেছে কিন্তু আমরা কেউ কিছুই পাইনি। শুধু গত রাতে খিচুড়ি দিয়ে গেছে এছাড়া অনুদানের নগদ টাকা, খাদ্যসামগ্রী কিছুই পাইনি আমরা।

হেমালা বেগম নামের আরেক গার্মেন্টস কর্মী বলেন, আগুনে আমার ঘর, জিনিসপত্র সব পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পাঁচ হাজার টাকা, খাদ্যসামগ্রী দেবে শুনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলাম তালিকা অনুযায়ী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই পেলাম না। শুধু আমি না আমাদের আশেপাশের কেউই পায়নি। তবে এই ত্রাণের জিনিস টাকা কারা পেল?

বস্তিবাসীর অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এই এলাকার ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিল মোহাম্মদ নাসির ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়র ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের পর আমাদের কাছে নগদ টাকা, ত্রাণ দিয়ে গেছেন। যেহেতু প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের অনুদান দিতে হবে, তাই আমরা তাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ করছি। এরপর আমরা নিজেরা উপস্থিত থেকে সবার মধ্যে এসব বিতরণ করব।

এএসএস/জেডএস