সাত মাস ধরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরির (সেজান জুসের কারখানা) নুডলস ম্যাকারনি শাখায় কাজ করতেন স্মৃতি (১৩)। তার সঙ্গে কাজ করা অধিকাংশ শ্রমিকই শিশু বলে জানান তিনি। গতকাল (বৃহস্পতিবার) আগুন লাগার ঘণ্টাখানেক আগে ছুটি পাওয়ায় বেঁচে যান স্মৃতি।

স্মৃতির বাড়ি কিশোরগঞ্জে। গত সাত মাস ধরে এখানে কাজ করছেন তিনি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সাত মাস ধরে নুডলস ম্যাকারনি শাখায় কাজ করি। নিচতলায় কারখানা। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি। তবে গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিকেল ৪টায় এক বান্ধবী অসুস্থ বোধ করায় ছুটি নিতে যাই। ছুটি দেয় কর্তৃপক্ষ। বাসায় আসার কিছুক্ষণ পর আগুনের খবর পাই। এক সপ্তাহ আগে কারখানার পঞ্চম তলায় আগুন লেগেছিল। তবে তা ছড়ানোর আগেই নিভে যায়। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় আমার চাচি অনুফা ও দাদি জাহানারা এখনো নিখোঁজ আছেন।

আগুনে ঝলসে যাওয়া কারখানা প্রাঙ্গণে কথা হয় বরিশালের আসমার সঙ্গে। তিনিও এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।  প্রথমে নিজের বয়স ২১ দাবি করলেও পরে জানান, ২০১৫ সালে ক্লাস সিক্সে (ষষ্ঠ শ্রেণি) পড়তেন। সাড়ে তিন বছর ধরে এ কারখানায় কাজ করছেন। তৈরি করতেন নসিলা চকলেট।

ঢাকা পোস্টকে আসমা বলেন, আড়াই বছর আগে নতুন ফ্লোর চালু হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) সেখানে আগুন লাগে। রাত ৮টায় ডিউটি ছিল। কিন্তু তার আগেই ঘটে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা। আমার বোন, বোনের মেয়ে ও ভাই এখানে কাজ করেন। তারা বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

ঝুমা নামের অপর এক শ্রমিক জানান, মা-খালার সঙ্গে এখানে কাজ করতেন। সকালের শিফট শেষে বাসায় ফেরেন। এখানে যারা কাজ করেন তাদের অধিকাংশের বাড়ি বরিশাল ও কিশোরগঞ্জে। নিহতদের মধ্যে এ দুই জেলার মানুষই বেশি।

ঝুমার দাবি, এখানে যারা কাজ করেন তাদের অধিকাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এটা নিয়ে তদন্ত হয়েছে। অনেক ঝামেলার কথাও শুনেছি। পরে ঠিক কী হয়েছে জানি না। নিহতদের মধ্যে অনেকেই অল্প বয়সী বলে শুনেছি।

শুক্রবার সন্ধ্যায় পুড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাটি দেখতে আসেন নজরুল ইসলাম। এখানে তার মেয়ে কাজ করতেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার মেয়ের বয়স ১২/১৩ হবে। এক মাস ধরে এখানে কাজ করছে। এর আগেও সে একই কোম্পানির অন্য একটি কারখানায় কাজ করত। গতকাল বিকেলে লাইনম্যানের সঙ্গে সে বাইরে বের হয়। এর ১০ মিনিট পর আগুন লাগে। এ কারণে বেঁচে যায়।

নিখোঁজ আরেক শ্রমিক ১৪ বছর বয়সী ফারজানা। গত তিন বছর ধরে পাঁচ হাজার টাকায় এ কারখানায় কাজ করছিলেন বলে জানান তার মা ঝরনা বেগম। মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে তিনি কারখানা এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন।

ফারজানার সহকর্মী ১৬ বছর বয়সী মৌমিতা জানান, হাসেম ফুডস কারখানায় সেজান জুস, চানাচুর, সেমাই, চকলেটসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হতো। বৃহস্পতিবার বিকেলে যখন আগুন লাগে তখন কাজে ছিলেন না। এ কারণে প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু ফারজানাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি আরও জানান, তার বয়সী অনেক কিশোর-কিশোরী ছিলেন কারখানার মধ্যে। কম বয়সীদের সাধারণত রাতের শিফটে রাখা হতো না।

আল-আমিন নামের এক ফায়ার ফাইটার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নিজে সাত-আটটি মরদেহ উদ্ধার করেছি। যাদের অনেকের বয়স ১৩-১৪ বছরের বেশি হবে না। ফায়ার সার্ভিসের লিডার মোজাম্মেল হকও বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, নিহতদের অনেকেই কম বয়সী।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ৪৯টি মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। এর আগে, বৃহস্পতিবার রাতে তিনজন মারা যান।

রূপগঞ্জের সেজান জুসের এ কারখানায় কম বয়সীরা কীভাবে কাজের সুযোগ পেল— এমন প্রশ্নের জবাবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রধান উপ-মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৪ বছরের বেশি বয়স হলে সে কাজ করার সুযোগ পাবে। তবে ১৪ বছরের নিচে কারও কাজের সুযোগ নেই। সেটা আইনত দণ্ডনীয়।

‘অগ্নিকাণ্ডের শিকার কারখানাটিতে শিশুদের কাজের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

শুক্রবার (৯ জুলাই) সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। এ বিষয়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন। উত্তরে তিনি বলেন, দেখে শিশু মনে হলেই তো হবে না, তারা যে শিশু এ বিষয়ে প্রমাণ দেখাতে হবে। যদি শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।

সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে শিশুশ্রমিক কাজ করেছে— এমন কোনো তথ্য আমরা এখনো পাইনি। ১৪ থেকে ১৮ বছরের নিচে কোনো শিশু এখানে কাজ করেছে কি না, তা এখনো জানা যায়নি। আমাদের একটি টিম এখানে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত তারাও এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে হাসেম ফুডস লিমিটেডের সাত তলা ভবনের নিচ তলার একটি ফ্লোরে হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। সময়ের সাথে সাথে আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় গোটা কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। জীবন বাঁচাতে ছাদ থেকেও কেউ কেউ লাফিয়েও পড়েন।

জেইউ/এসকেডি/জেএস