লিজার মেহমানখানায় প্রতিদিন তিন হাজার অতিথি
মহামারি করোনাকালে অসহায়, অভুক্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের সেবায় এক অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মেহমানখানা’। প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার অভুক্ত মানুষের মুখে একবেলা খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে। এই কার্যক্রমের সময়টাও নেহায়েত কম নয়। প্রায় দেড় বছর ধরে চলছে তাদের এই কর্মযজ্ঞ।
আয়োজকরা জানালেন, করোনাকালে কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে অসংখ্য মানুষ। আবার অনেকের রোজগারেও পড়েছে ভাটা। পরিবার-পরিজন নিয়ে একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দরিদ্র এ পরিবারগুলোকে। তাই এ মানুষদের সেবায় মেহমানখানায় এমন আয়োজন। এখানে যে কেউ খাবার খেতে পারেন। খাওয়ার পর যদি কেউ তার পরিবার-পরিজনের জন্য খাবার নিয়ে যেতে চান, তবে তার সুযোগও রয়েছে। মানুষজনের খাবারের কষ্ট লাঘব করার এই আয়োজনে কেউ যেন সংকোচ বোধ না করে তাই খাবার খেতে আসা মানুষদের সম্বোধন করা হয় মেহমান হিসেবে।
বিজ্ঞাপন
প্রতিদিনই প্রায় তিন হাজার মানুষের খাবারের আয়োজনে সকাল ১০টা থেকে কাজ শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। শুধুমাত্র অসহায় মানুষদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্য বিনা পারিশ্রমিকে দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
রোববার (১১ জুলাই) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া আবাসিক এলাকার ডি ব্লকে মেহমানখানার এমন বিশাল কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিকেল ৫টা থেকে আসতে শুরু করেন মানুষজন। রিকশাচালক, পথচারী, দিনমজুর, দারোয়ান, নির্মাণ শ্রমিক, পথশিশুসহ অসংখ্য মেহমানের পদচারণায় সন্ধ্যার আগেই মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। সন্ধ্যা ৬টা থেকেই শুরু হয় খাবার বিতরণ। সারিবদ্ধভাবে রাস্তার দু’পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে আয়েশ করে ফুটপাতেই খেতে বসেন তারা। খাবার বিতরণ করা হয় দুটি বুথ থেকে। একটিতে তাৎক্ষণিক খাওয়ার জন্য, অপরটিতে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য খাবার সরবরাহ করা হয়। যারা খাবার বাড়িতে নিয়ে যেতে চান তারা স্বেচ্ছাসেবীদের পরিবারের সদস্যের সংখ্যা বললেই সেই মতো খাবার দিয়ে দেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
এই মেহমানখানা থেকে দুই মাস ধরে বিনামূল্যে খাবার খাচ্ছেন রিকশাচালক আব্দুল মজিদ। তিনি জানালেন, প্রথমে একদিন যাত্রী নিয়ে এদিকে আসার পর দেখেন বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হচ্ছে। সেদিন খাবার নিতে এসে জানতে পারেন প্রতিদিনই এখানে খাবারের আয়োজন করা হয়। সেই থেকে প্রায় প্রতিদিনই রিকশা চালানোর পর বিকেল নাগাদ এখানে খেতে আসেন।
আরেক রিকশাচালক গফুর মিয়া বললেন, সারাদিন রিকশা চালানোর পর যে টাকা আয় হয় তার বেশির ভাগই চলে যায় খাবার খরচ বাবদ। আর এখানে এলে বিনামূল্যে খাবার খেতে পারি। বিকেলের খাবারও হয় আবার রাতের জন্য খাবার নিয়ে যেতেও পারি। এতে করে আমাদের খাবার খরচের টাকাটা বেঁচে যায়। আর খরচ বেশি হওয়ার ভয়ে কখনো তো ভালোভাবে খাই না, কিন্তু এখানে এলে পেট ভরে খেতে পারি।
খাবার খাওয়ার পর পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য পাতিলে করে খাবার নিয়ে যাচ্ছিলেন আসমা বেগম। তিনি বললেন, আবাসিক এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে যা আয় হতো তা দিয়েই দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে আমার সংসার চলতো। কিন্তু করোনার কারণে এখন অনেক বাড়িতেই কাজ করতে যেতে পারি না। তারা ভয় পায়, আমাদের যেতে মানা করে। যার কারণে আয় না থাকায় অনেক বেশি বিপদে পড়েছিলাম। কিন্তু এখান থেকে এক বেলা নিয়মিত খাবার খেতে পারছি, আবার বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারছি। এতে আমার অনেক উপকার হচ্ছে।
প্রতিদিন চারটি বড় হাঁড়িতে করে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের খাবার রান্না করা হয় জানিয়ে রান্নার দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবক মনিরুজ্জামান বলেন, অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই আমাদের এই আয়োজন। কষ্ট হলেও সেটি কখনো কষ্ট মনে করি না। কারণ, যারা খাবারের জন্য কষ্ট করে তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছি, এটি বড় তৃপ্তি আমাদের জন্য।
স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদৌস শোভা। তিনি বলেন, স্কুল বন্ধ থাকায় এখন তেমন কাজ নেই। তাই এই স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছি। নিজের মধ্যে অনেক ভালো লাগা কাজ করে। প্রতিদিন এতগুলো মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছি, এটা আনন্দের বিষয়। তারা খাবার খেয়ে যে তৃপ্তি প্রকাশ করছে, আমাদের জন্য দোয়া করছে এটা আমাদের জন্য অনেক বেশি।
এই বিশাল আয়োজনের পুরোধা সমাজকর্মী ও লেখিকা আসমা আক্তার লিজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যাতে মানুষের কোনো হাত নেই। কিন্তু এই যে মানুষজন খাবারের জন্য কষ্ট করছে, সেটি লাঘবের জন্য তো আমাদের কিছু করার রয়েছে। মূলত এই চিন্তা-ভাবনা থেকেই আমার এই কার্যক্রমের পথ চলা শুরু হয়। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে আমরা বিনামূল্যে প্রতিদিন খাবারের আয়োজন করছি এবং যতদিন এই পরিস্থিতি থাকবে ততদিন আমরা এই আয়োজন করে যাব।
মেহমানখানার অর্থের যোগান কিভাবে হয় তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের টাকা দিয়ে এই কার্যক্রম চালু করি। তবে এখন অনেকের সাড়া পাচ্ছি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী বিভিন্ন স্তরের মানুষজন আমাদের সহায়তা করছেন।
যেকোনো পরিস্থিতিই হোক, যতদিন পর্যন্ত এই আপদকাল চলবে, ততদিন পর্যন্ত অসহায় মানুষদের জন্য আয়োজন অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
আরএইচটি/এনএফ