প্রাণঘাতী করোনার মধ্যেও যথাযথ মর্যাদা, আনন্দ ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পালিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের প্রধান প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হলেও পশু কোরবানির সময় সেভাবে তা প্রতিপালিত হয়নি। মাস্ক ছাড়াই কোরবানি এবং অবাধ বিচরণের চিত্র লক্ষ করা গেছে সর্বত্র। চলমান অতিমারির মতো এক বিরুদ্ধ পরিবেশে পালিত হওয়ায় স্বাভাবিক উচ্ছ্বাসেও এবার কিছুটা ঘাটতি ছিল

তারপরও সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে পালিত হয়েছে মুসলিমদের অন্যতম প্রধান এ ধর্মীয় উৎসব। মূলত জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মহান আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপিত হয়। আমাদের দেশে যা ‘কোরবানির ঈদ’ নামে পরিচিত। বুধবার (২১ জুলাই) এটি পালিত হলেও ঈদের পরের দুদিন, অর্থাৎ ১১ ও ১২ জিলহজ (বৃহস্পতি ও শুক্রবার) কোরবানির বিধান রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এ দুদিনও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর কোরবানি হবে।

সংক্রমণ বিস্তার রোধে সরকারের নির্দেশনা অনুসারে এবার খোলা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি। মসজিদে মসজিদে হয়েছে ঈদের জামাত। রাজধানীতে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। এখানে মোট পাঁচটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি জামাতে মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অংশ নেন মুসল্লিরা।

সকাল ৭টায় অনুষ্ঠিত প্রথম জামাতে ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মো. মিজানুর রহমান। পর্যায়ক্রমে সকাল ৮টা, ৯টা, ১০টা এবং ১০টা ৪৫ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় জামাতগুলো। নামাজ শেষে খুতবা পাঠ করা হয়। এরপর অনুষ্ঠিত হয় দোয়া ও বিশেষ মোনাজাত। বিশেষ মোনাজাতে করোনা মহামারি থেকে মুক্তি এবং দেশ, জাতি ও বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনা করা হয়। এ সময় মুসল্লিরা দু'চোখের পানি ফেলে মহান স্রষ্টার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চান।

করোনার অমানিশার আঁধার সহসাই কেটে যাবে, ইনশাআল্লাহ : রাষ্ট্রপতি

এদিকে, বঙ্গভবনে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বুধবার (২১ জুলাই) সকাল সাড়ে ৮টায় বঙ্গভবনের হলওয়েতে নামাজে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্য ও বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জামাতে অংশ নেন। নামাজ শেষে দেশ ও জাতির কল্যাণে মোনাজাত করা হয়।

রাষ্ট্রপতি নামাজ শেষে দেশবাসীর উদ্দেশে ঈদের শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে আমি দেশবাসীসহ বিশ্বের সকল মুসলিম ভাই-বোনদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ। মহান আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর পবিত্র ঈদুল আজহা।

তিনি বলেন, এবার মুসলিম বিশ্ব এমন একটি সময়ে ঈদুল আজহা উদযাপন করছে যখন করোনার ভয়াল থাবায় গোটা বিশ্ব বিপর্যস্ত। বাংলাদেশেও করোনার নেতিবাচক প্রভাব ক্রমান্বয়ে প্রকট হচ্ছে। সরকার করোনা মোকাবিলা ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিভিন্ন প্যাকেজ প্রণোদনা প্রদানসহ বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। অসচ্ছল ও নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ লাঘবেও বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত আছে। কৃষি ও শিল্পসহ উৎপাদনশীল প্রতিটি খাতের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেও সরকার সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, রাতের আঁধার শেষেই ঝলমলে রোদের আলোতে ভরে ওঠে পৃথিবী। করোনার অমানিশার আঁধারও সহসাই কেটে যাবে, ইনশাআল্লাহ। সঠিকভাবে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি। রাষ্ট্রপতি কোরবানির মর্মার্থ অনুধাবন করে সংযম ও ত্যাগের মানসিকতায় উজ্জীবিত হয়ে মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোরও আহ্বান জানান।

এদিকে, ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিআয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল জামে মসজিদ ও ফজলুল হক মুসলিম হল মসজিদে। রাজধানীর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ মসজিদে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া, ঢাকার মসজিদ এবং ধানমন্ডি ঈদগাহ মসজিদ, লক্ষ্মীবাজার নূরানী জামে মসজিদ, লক্ষ্মীবাজার মিয়া সাহেব ময়দান খানকা শরীফ জামে মসজিদ, লালবাগ জে এন সাহা রোডস্থ বায়তুস সালাম জামে মসজিদ, লালবাগ গফুর মসজিদ, কারওয়ানবাজার আম্বর শাহ জামে মসজিদ, চকবাজার ইসলামবাগ বড় মসজিদে কয়েকটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়।

২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব বর্জ্য অপসারণ

ঈদের জামাত শেষে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে শুরু হয় পশু কোরবানি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এদিন লাখ লাখ পশু কোরবানি দেওয়া হয়। পশু কোরবানির পর এর বর্জ্য অপসারণেও নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ইতোমধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে তারা কাজও শুরু করেছেন। রাত ৯টা নাগাদ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে শতভাগ বর্জ্য অপসারিত হয়েছে বলে সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়েছে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঢাকার সব বর্জ্য অপসারণের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন দুই সিটির মেয়র।

কোরবানির চামড়া নিয়ে এবারও হতাশা 

এদিকে, কোরবানি পশুর চামড়া নিয়ে এবারও কোরবানিদাতা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, গতবারের মতো এবারও চামড়ার মূল্য তারা পাচ্ছেন না। সরকার নির্ধারিত মূল্যে কেনা বা বিক্রি হচ্ছে না কোনো চামড়া। আড়তদাররাও নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কিনছেন না বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এবার একটি বড় গরুর চামড়া গড়ে বিক্রি হয়েছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। মাঝারি গরুর চামড়ার দর ছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। আর ছোট গরুর চামড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় কেনা-বেচা হতে দেখা গেছে।

ঢাকা ছেড়েছেন ৮৩ লাখ মানুষ

বুধবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানিয়েছেন, গত ১৫ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৮৩ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। ঈদের দিন অর্থাৎ ২১ জুলাইও ঢাকা ছেড়েছেন অসংখ্য মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় কোটির ওপর মানুষ ঢাকা ছেড়ে নিজ নিজ এলাকায় ঈদ উদযাপনে গেছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এত সংখ্যক মানুষ সামনের একদিনে (২২ জুলাই) কীভাবে ঢাকায় ফিরবেন?

২৩ জুলাই থেকেই কঠোর বিধিনিষেধ

এদিকে, গুঞ্জন ছড়িয়েছে যে বিধিনিষেধ শিথিলের মেয়াদ বাড়িয়ে ২৭ জুলাই করা হতে পারে। কারণ, একদিনের মধ্যে এত সংখ্যক মানুষের পক্ষে ঢাকা ফেরা সম্ভব নয়। তবে বুধবার রাতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন যে, লকডাউনের বিষয়ে সরকার আগের অবস্থানেই আছে। অর্থাৎ ২৩ জুলাই ভোর থেকে আবারও ১৪ দিনের শাটডাউনে যাচ্ছে দেশ।

পিএসডি/এমএআর/