জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ডাংধরা ইউনিয়নের বাঘার চর ব্যাপারী পাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। ছবি : ঢাকা পোস্ট

মুজিববর্ষে উপহার হিসেবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দুস্থদের মাঝে গত জানুয়ারি এবং জুন মাসে এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮০টি ঘর হস্তান্তর করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের এই প্রকল্পে বেশ কয়েকটি এলাকায় নির্মিত ঘরের মান নিয়ে উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। কোথাও নির্মিত ঘর ধসে পড়েছে, কোথাও ঘরের নিচের বালু সরে ভবনে ফাটল ধরেছে।

প্রকল্পের ঘর নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার ও সরকারি অর্থ আত্মসাৎ এমনকি গৃহহীনদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় ঘর তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। এরই মধ্যে এক উপসচিবসহ সরকারের পাঁচ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। 

বগুড়ায় উপহারের ৭ ঘর ভেঙে পুনর্নির্মাণ

সরকারের মহৎ এমন উদ্যোগেও যারা দুর্নীতির বিষ ছড়িয়েছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করার প্রধান দায়িত্ব পালন করা উচিত বলে মনে করেন তারা।

অভিযোগ ওঠার পর বসে নেই দুদক। ডজনখানেক অভিযোগের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নেমেছে সংস্থাটি। অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নজর রাখছে দুদক। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। 

লালমনিরহাটে সামান্য ঝড়ে ভেঙে গেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের তফসিলভুক্ত সকল দুর্নীতির বিরুদ্ধেই দুদক কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। করোনাসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ কাজ শুরু ও শেষ করতে দুদককে যৌক্তিক সময় দিতে হবে।

তবে মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ডাকযোগে ও ই-মেইলে অনেকগুলো অভিযোগ জমা পড়েছে। দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটি এগুলো গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে এবং গোয়েন্দা ইউনিট থেকেও ওই সব কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তদন্ত কমিটির কার্যক্রমেও নজর রাখা হচ্ছে। ওই কমিটির রিপোর্টও আমলে নেওয়া হবে। করোনাসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দুদক কাজ করে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্নীতি ও দুদকের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের ভূমিকাটা পরিষ্কার নয়। কারণ, এখানে দুর্নীতি অবশ্যই আছে। অব্যবস্থাপনা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও নির্মাণ ডিজাইনের ত্রুটিও রয়েছে। যার সঙ্গে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকেই তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে, তাই হয়ত প্রথম পর্যায়ে দুদক এ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেনি। তাছাড়া দুদকেরও অনেক কাজের চাপ রয়েছে। 

বগুড়ায় উপহারের ঘর 

তিনি আরও বলেন, মূল বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে জনকল্যাণমূলক এমন একটি প্রকল্পে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, সেটা আসলেই অপ্রত্যাশিত। এর সঙ্গে আবেগের বিষয় রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো এর সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল (ঠিকাদার) জড়িত। এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা অনেকটা বিভাগীয় ব্যবস্থা বলা যায়। তবে এ ধরণের অপরাধে শুধুমাত্র ওএসডি করাই বড় কথা নয়। এজন্য সরকারের উচিত দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেহেতু দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে কিংবা অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে তাই সরকারেরও উচিত দুদকের কাছে বিষয়টি হস্তান্তর করা।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীন ও ঘরহীন পরিবারকে দুই কক্ষের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। বর্ষা শুরুর পর কিছু এলাকায় ঘর ভেঙে যাওয়া এবং ফাটলের ঘটনা গণমাধ্যমে আসে। কারো কারো বিরুদ্ধে তালিকা অনুযায়ী ঘর না দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। 

ঝিনাইদহে বাঁশের খুঁটিতে ভর করছে উপহারের ঘর

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুসারে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো সরকারি খাস জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে। ঘরের আয়তন ৪০০ বর্গফুট। প্রতিটি ঘরে আছে দুটি কামরা, রান্নাঘর, বারান্দা এবং টয়লেট। এছাড়া ১০টি ঘরের জন্য একটি করে গভীর নলকূপ। প্রতিটি সেমিপাকা ঘর তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৬১ হাজার টাকা। প্রতিটি ঘর তৈরি করতে প্রথম পর্যায়ে খরচ হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে খরচ হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় পর্যায়ে দুই লাখ টাকা। প্রতিটি পরিবারকে দুই শতাংশ জমিসহ এই ঘর দেওয়া হয়।

ঘর দেওয়ার আগে ও পরে নানা ধরনের অনিয়মের খবর প্রকাশ হয়। যেমন কুড়িগ্রামের রৌমারীতে হস্তান্তরের আগেই পাঁচটি ঘর ধসে পড়ে। গোপালগঞ্জে হস্তান্তরের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে পড়েছে দুইটি ঘর। ঘরগুলো বৃষ্টির কারণে বালু সরে গিয়ে ভেঙে পড়ে। লালমনিরহাটে ঝোড়োবাতাসে উড়ে গেছে দুটি ঘর। বগুড়ায় দুই দিনের বৃষ্টিতেই একাধিক ঘর ধসে পড়েছে। বগুড়ার শেরপুরে কায়রাখালী বাজারের কাছে খালের পাড়ে নির্মিত ঘরগুলো এখন ভাঙনের সম্মুখীন। বরগুনার আমতলীতে নির্মিত ঘরের গুণগত মান ঠিক নেই। সুনামগঞ্জের শাল্লায় ডিজাইন বহির্ভূত ঘর নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

কুড়িগ্রামে মাটি ধসে ভেঙে পড়েছে চারটি ঘর

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোয় বলা হয়েছে, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ঘরগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায়ই নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ঘর বরাদ্দের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ গৃহহীনদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এখন পর্যন্ত ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় ঘর তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। আরও অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। অনিয়মের অভিযোগে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে সাবেক ইউএনও (বর্তমানে উপসচিব) শফিকুল ইসলাম, বগুড়ার শেরপুরের সাবেক ইউএনও মো. লিয়াকত আলী শেখ (বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক), মুন্সিগঞ্জ সদরের সাবেক ইউএনও রুবায়েত হায়াত, বরগুনার আমতলীর ইউএনও মো. আসাদুজ্জামান ও মুন্সিগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ মেজবাহ-উল-সাবেরিনকে ওএসডি করা হয়েছে। এদের মধ্যে উপসচিব শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। 

আরএম/এইচকে