বড় ভাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার সংবাদে ওমান থেকে দেশে ছুটে আসেন মো. সুলতান। চট্টগ্রামে নেমেই তিনি সরাসরি আসেন ঢাকায়। অন্যদিকে গাজীপুর থেকে নিয়ে আসা হয় আহত বড় ভাই জুয়েলকে। কিন্তু শ্যামলীতে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতালে) এসে তাদের পড়তে হয় দালালের খপ্পড়ে। ফলে গোটা রাতে ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। 

সুলতান জানান, ৪ জুলাই রাতে তার ভাইকে হাসপাতালে নিতেই সেখানকার আয়ারা জানান, এখানে ডাক্তার নেই। দালালদের দেখিয়ে বলে দেন, তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। এবার দালালরা সুলতানকে বলেন হাসপাতালে ভর্তি করতে হলে ১০ হাজার টাকা লাগবে। 

পরে পরিচিত একজনের সহযোগিতায় ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করান তিনি। সুলতানের দুঃখ- দেশে এসেও ভাইকে রাতেই ভর্তি করাতে পারেননি হাসপাতালে, তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে পারেননি। তিনি বলেন, সারা রাত আহত ভাইকে নিয়ে ছটফট করেছি, কেঁদেছি।  
শুধু সুলতান নয়, এমন শত শত মানুষ দুর্ঘটনায় আহত তাদের স্বজনদের এই পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে এসে পড়ছেন বিভ্রান্তিকর এক পরিস্থিতিতে। দালালদের খপ্পড়ে পড়ে কারো ভর্তি হতে লাগছে মোটা অঙ্কের টাকা, কাউকে বা ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বেসরকারি নামসর্বস্ব হাসপাতালে।

এমনই সব সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) বিকেলে পঙ্গু হাসপাতালে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। 

র‌্যাব-২ এর সহযোগীতায় সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। অভিযানকালে হাতেনাতে ৯ দালালকে গ্রেফতার করা হয়। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেন- মো. নাহিদুল ইসলাম (২৫), মো. সজিব (৩২), তমাল বাড়ৈ (২৪), মাসুদ রানা (৩৫), মো. হাসান (২৪), মো. শরিফ (২২), মো. রোমান (৩০), মানিক মিয়া (৩০) এবং মো. কামাল হোসেন (৪৫)। আদালত তাদের প্রত্যেককে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেছেন।

পঙ্গু হাসপাতালে এসে সুলতানের মতোই দালালের খপ্পড়ে পড়েছিলেন ধামরাইয়ের জসিম। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, বৃদ্ধা দাদী বৃষ্টিতে পা পিছলে পড়ে মাজায় আঘাত পান। তাকে নিয়ে তিনি সোমবার পঙ্গু হাসপাতালে আসেন। দালালের খপ্পড়ে পড়ে বৃদ্ধা দাদীকে তিনি নিয়ে যান ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করতে না করতেই পকেট থেকে খসানো হয় ১২ হাজার টাকা। পরিচিত এক আনসারের মাধ্যমে বুঝতে পারেন তিনি দালালের খপ্পড়ে পড়ে ভুল জায়গায় এসেছেন।

জসিম বলেন, আমি চেষ্টা করেও দালালদের খপ্পড় থেকে দাদীকে পঙ্গুতে ভর্তি করাতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে র‌্যাবকে জানাই।

আরেক ভুক্তভোগী ঝিনাইদহের মহেষপুরের বাসিন্দা মো. সেলিম। তিনি মাহেন্দ্র গাড়িতে দুর্ঘটনায় পা হারানো ছেলে রাজিবকে নিয়ে আসেন পঙ্গুতে।

তিনি বলেন, এখানে আসার পর দালালরা আমাকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি ঢাকার কোনো পথঘাট চিনি না। কখনো ঢাকায় আসিওনি। ছেলেকে নিয়ে বড় বিপাকে পড়ি। আজ বেসরকারি একটি হাসপাতালে ছেলেকে ভর্তি করানোর কথা ছিল। তার আগেই র‌্যাব এসে দালালদের ধরে ফেলে। এর আগে বুঝিনি আমি দালালের খপ্পড়ে পড়েছিলাম।

পঙ্গু হাসপাতালে র‌্যাব-২ এর অভিযান শেষে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংঘবদ্ধ দালালচক্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে র‌্যাব-২। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় আমরা দালাল চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছি।

পলাশ কুমার বসু বলেন, এখানে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের নানাভাবে ভুল বোঝানো হয়। দালালচক্রের সদস্যরা জানায়, এখানে ভালো চিকিৎসা হবে না। সিট পাবেন না, সিট না পেলে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হবে। এইসব কথায় ফাঁদে ফেলে সাধারণ রোগীদের ভাগিয়ে নেওয়া হয় নামসর্বস্ব হাসপাতালে। ওই হাসপাতালগুলোতে যেমন ভাল চিকিৎসাও হয় না, তেমনি সাধারণ মানুষের পকেট থেকে খরচা হয়ে যায় মোটা অংকের টাকাও।

কিছু দিন পর পর র‌্যাব অভিযান চালায় কিন্তু দালাল চক্রকে নির্মূল করা যাচ্ছে না কেন? জানতে চাইলে পলাশ কুমার বসু বলেন, অনেক দালালই গ্রেফতারের পর শাস্তি ভোগ করে ফের একই কাজে জড়াচ্ছে। যদিও নিয়মিত র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান পরিচালনা করে আসছে।

পলাশ বসু বলেন, চিকিৎসা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। কেউ তাদের সে অধিকার ক্ষুন্ন করলে তা বরদাশত করার সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই র‌্যাব অভিযান পরিচালনা করছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যারই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

পঙ্গু হাসপাতালের কারো দালাল চক্রের সাথে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে পলাশ বসু বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত হাসপাতালের কারো সংশ্লিষ্টতা পাইনি। তবে পঙ্গুর আশপাশের অনেক নাম সর্বস্ব হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছি। আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেসব নাম সর্বস্ব হাসপাতালেও অভিযান পরিচালনা করবো।

জড়িত থাকলে হাসপাতালের কাউকে ছাড় নয়
পঙ্গু হাসপাতালের সহযোগী রেজিস্ট্রার ডা. মুহাম্মদ রাকিব হুসাইন বলেন, হাসপাতালে দালালদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যতবারই অভিযান হয়েছে তাতে হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কাউকে পাওয়া যায়নি। দালালরা সবাই বহিরাগত, এদের বারবারই ধরা হচ্ছে। এটি দেশের সবচেয়ে বড় ট্রমা হাসপাতাল। আমরা এখানে রোগী নিয়ে যে পরিমাণ ব্যস্ত থাকি তাই বাইরে কী হচ্ছে দেখা সম্ভব হয় না।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচালনায় নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, একে আমরা সাধুবাদ জানাই।

হাসপাতালের আয়া ও নার্সদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বাইরে থেকে দালালরা রোগীদের বলছে চিকিৎসক নেই। কিন্তু হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখতে পারবেন চিকিৎসকরা সবাই রোগী নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। হাসপাতালের আয়া, বুয়া ও নার্সদের দালালচক্রের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যদি হাসপাতালের কেউ জড়িত থাকে তাহলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।

জেইউ/এনএফ