চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন জুলাই মাসে। মৃত্যুও বেশি হয়েছে এ মাসে। জুলাইয়ে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ২৩৫ জন। এ সময়ে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬১ জনের। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোকজনের মাস্ক পরায় অনীহা এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতার কারণে করোনা পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। করোনাকে অবহেলা করায় গ্রামে মৃত্যুহার বেশি বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। অন্যদিকে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী আশঙ্কা করছেন আগস্টেও চট্টগ্রামে করোনার সংক্রমণ বাড়বে।

এদিকে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় চট্টগ্রামের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউগুলো সব সময় রোগীতে পরিপূর্ণ থাকছে। হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যা কয়েক দফা বাড়ানোরও রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ১ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ২৩৫ জন, যা এক মাসে সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড। এ সময়ে চট্টগ্রাম নগরীতে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ৬৮৯ জন আর নগরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন সাত হাজার ৫৪৬ জন। এর আগে চলতি বছরের এপ্রিলে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছিল ৯ হাজার ৯০৯ জন।

জুলাই মাসে চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৬১ জন, যা এক মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর ১০৩ জন আর চট্টগ্রাম নগরের বাইরের অর্থাৎ বিভিন্ন উপজেলায় মারা গেছেন ১৫৮ জন। চট্টগ্রামে জুলাইয়ে নগরীর চেয়ে গ্রামে করোনা আক্রান্ত হয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

অথচ আগের মাসে অর্থাৎ জুনে চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫ হাজার ২৫৯ জন। আর করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ৭৯ জনের।

চট্টগ্রামে গতবছরের ৩ এপ্রিল প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। প্রথম মাসে অর্থাৎ ২০২০ সালের এপ্রিলে মোট শনাক্ত হয় ৭৩ জন। পরের মাসে (মে) দুই হাজার ৯১২ জন, জুনে পাঁচ হাজার ৮৮৩ জন, জুলাইয়ে পাঁচ হাজার ৮৫৮ জন, আগস্টে দুই হাজার ৭১৪ জন, সেপ্টেম্বরে এক হাজার ৭৫৩ জন, অক্টোবরে দুই হাজার ৩৭৯ জন, নভেম্বরে তিন হাজার ৯৫১ জন ও ডিসেম্বরে পাঁচ হাজার ২০৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়।

এরপর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সংক্রমণ কমে শনাক্ত হয় দুই হাজার ৬২৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৯২৩ জন। এরপর আবারও করোনার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মার্চে চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল পাঁচ হাজার ১১০ জন, এপ্রিলে আক্রান্ত হয় ৯ হাজার ৯০৯, মে মাসে তিন হাজার ২৮০, জুনে পাঁচ হাজার ২৫৯ জন। সবশেষ জুলাইয়ের ২৯ দিনে ২১ হাজার ৪৮০ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে।

চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮১ হাজার ২১৭। এদের মধ্যে নগরীর ৬০ হাজার ৯০৭ ও উপজেলার ২০ হাজার ৩১০ জন। চট্টগ্রামে গত বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) মারা গেছেন ৯ জন, এ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৯৫৮ জনের। তাদের মধ্যে নগরীর ৫৭৪ ও উপজেলার ৩৮৪ জন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর প্রচণ্ড চাপ। আগস্টেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে। এরপরও মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে হলে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। বাসায় কেউ অসুস্থ হলে আইসোলেশনে চলে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে করোনা টেস্ট করাতে হবে।

তিনি আরও বলেন, করোনা আক্রান্তদের সেবা দিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেড সংখ্যা বাড়িয়েছি, আইসিইউ শয্যাও বাড়িয়েছি।

চট্টগ্রামে শহরের চেয়ে গ্রামে করোনায় মৃত্যুর হার বেশি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামের মানুষ করোনাকে সাধারণ জ্বর ভেবে অবহেলা করে। যখন তাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে তখন চট্টগ্রাম নগরীর হাসপাতালের দিকে আসে। এমন অবস্থায় আসে যখন চিকিৎসকদের আর কিছু করার থাকে না। করোনাকে অবহেলা করে চিকিৎসা নিতে কালক্ষেপণ নেয়। দেখা যায় সাত-আট দিন পর চিকিৎসকের কাছে আসে। সেই সময়ে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তখনই রোগী মারা যায়। এক কথায় বলা যায়, করোনাকে অবহেলা করার কারণে গ্রামে মৃত্যুহার বেশি। করোনা যে ভিন্ন ধরনের রোগ তারা তা বুঝতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, ঈদুল আজহার ছুটি ও তার আগে সবকিছু খোলা ছিল। এছাড়া শহর থেকে গ্রামে যাতায়াতের কারণে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না। যে কারণে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। করোনা আক্রান্ত রোগী বাড়ার কারণে চিকিৎসারও একটি সংকট তৈরি হয়েছে।

বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, আশা করছি আগস্টে করোনার সংক্রমণ কমে আসবে। কারণ এতদিন যে বিধিনিষেধ ছিল তার কিছুটা সুফল পাওয়া যাবে। তবে এজন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে পরীক্ষা বাড়লেই শনাক্ত বাড়ছে। এজন্য পজিটিভ রোগীদের আইসোলেশন নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে হবে। তাহলে অন্তত রোগ নিয়ন্ত্রণে আসবে। এছাড়া জেলার হাসপাতালগুলোর সুবিধাও বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, প্রথমে মানুষ করোনাভাইরাসের ভয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলত। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে মানুষের মাস্ক পরায় অনীহা দেখা গেছে। তাই আমরা বলছি মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সামাজিক কমিটি করতে হবে। তাদের হাতে দায়িত্ব দিতে হবে। তাদের বলে দিতে হবে, কেউ করোনা বিধি না মানলে তাকে তারা যেন মানাতে বাধ্য করেন।

কেএম/এসএসএইচ