আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত

শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত। সিলেটের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। অধ্যায়নকালীন সময়ে হিযবুত তাহরীরে যুক্ত হন। তিনি সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় শীর্ষ পর্যায়ে চলে যান। ২০০৯ সালে আনসার আল ইসলামে যােগ দেয়। ২০১১ সালে মেডিকেল শিক্ষার্থী ডা. নুসরাতকে বিয়ে করেন। স্ত্রীও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। তবে দেরিতে হলেও নিজের ভুল বুঝতে পারেন শাওন।

র‍্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এসে শাওন বলেন, ‘আজ এক নতুন শাওনের জন্ম হলো।’

র‍্যাব জানায়, সংগঠনের নির্দেশনায় সিলেট থেকে ঢাকায় আসে শাওন। ২০১৭ সাল থেকে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার আতঙ্কে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বাসা বদল করে থাকতেন। এক পর্যায়ে ঢাকার আশেপাশের এলাকায় বসবাস শুরু করে।

বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরে র‍্যাব সদর দফতরে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান 'নব দিগন্তের পথে' নিজের অনুভূতি প্রকাশকালে শাওন বলেন, ছাত্র থাকাকালীন আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় বিভিন্ন পোস্ট দেখে আকৃষ্ট হই। ২০০৯ সালে জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি শাখায় কাজ শুরু করি। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকি। এক পর্যায়ে আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে মোটিভেট করতে সক্ষম হই। তবে এখন পর্যন্ত আমি নিজে কখনও কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হইনি। 

শাওন বলেন, আমার দায়িত্বশীলের নির্দেশনায় দাওয়াতি শাখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে যুক্ত হই। 

জঙ্গি থাকাকালীন অস্বাভাবিক জীবন যাপন সম্পর্কে শাওন বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছিলাম না। এরপর আমি বাধ্য হয়ে নিজে জঙ্গি সংগঠন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করি। এসময় আমি ও আমার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করি। 

তিনি জানান, আমি যখন হিজরতে ছিলাম, তখন আমার ও পরিবারে ওপর অনেক দুর্ভোগ নেমে আসে। তখন পুরো সমাজ থেকেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয় যাই। আমার স্ত্রী একজন চিকিৎসক। কিন্তু জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে তার জীবনেও চরম গ্লানি নেমে আসে। আমার সন্তানের জীবনেও অন্ধকারের কালো ছায়া নেমে আসে। এক কথায় আমার নিজের সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু ছিল না। 

অনেক সময় দেখা যেত নিরাপত্তাহীনতার কারণে মসজিদে গিয়ে ঠিকমত নামাজও পড়তে পারতাম না। ঘরেই পড়তে হতো। এসবের পর এক সময় আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। আমি ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার হয়েছিলাম। নিজেই অনুশোচনার বেড়াজালে আটকা পড়ে যাই। 

তিনি আরো বলেন, তখন আমার ভেতরে নতুন বোধোদয় হয়। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। পরিবার বন্ধুদের নিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখি। এরপরও আমি ভীতু ছিলাম। তারপর পরিবারের মাধ্যমে র‍্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। শুরুতে কিছুটা দ্বিধার মধ্যে থাকলেও র‍্যাব ভয়-ভীতি, দ্বিধা সব দূর করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। র‍্যাব আমাকে ও আমার পরিবারকে স্বাভাবিক জীবনে আসার জন্য সাহস দেয়। আমি র‍্যাবের কাছে এর জন্য কৃতজ্ঞ। 

আজ এক নতুন শাওনের জন্ম হলো। বাংলাদেশ সরকারের জঙ্গি পুর্নবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে আমি নিজেকে আবার ফিরে পাচ্ছি। আমাদের আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া ও আমার কাছে আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। 

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত

সবার উদ্দেশ্যে আমি একটি কথা বলতে চাই- আমি যে পথে হেঁটেছি, তা ভুল পথ। তরবারির ঝনঝনানি, এটা সেই যুগের কথা। এখন জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগ, শিক্ষার যুগ, মননশীলতা, চিন্তা সৃষ্টিশীলতার যুগ। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী গড়ে তোলার যুগ। আমরা কেউ যেন ইসলাম নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা প্রভাবিত না হই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। আসুন আমরা ইসলাম অনুসরণ করি, একটা সত্য সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

উল্লেখ্য, জঙ্গি দমনে সবচেয়ে সফল পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাবের সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে ফুল দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন নয় জঙ্গি। 

আত্মসমর্পণ করা ৯ জঙ্গিকে 'ডি-রেডিক্যালাইজেশন' অ্যান্ড 'রিহ্যাবিলিটেশন' এর মাধ্যমে সন্ত্রাস ও চরমপন্থার জীবন পরিত্যাগ করে শান্তি ও আলোর পথে তথা সমাজের মূলধারায় নিজেদের সমর্পণ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

এ উপলক্ষে র‍্যাব সদর দফতরের শহীদ লে. কর্নেল আজাদ মেমোরিয়াল হলে ‘নব দিগন্তের পথে’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। র‍্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে জঙ্গি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন, পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রধান খন্দকার ফারজানা রহমান, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের সিটি এডিটর আবুল খায়ের।

জেইউ/ওএফ