চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী, সাধারণের বাঁচার আকুতি
আমদানি শুল্ক কমিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না চালের বাজার | ফাইল ছবি
• সরকারি হিসাবে চালের বর্তমান মজুত ৫ লাখ ৩১ হাজার টন
• গত বছর একই সময়ে মজুত ছিল ১১ লাখ ৫০ হাজার টন
• শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তেও চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না
• বন্যায় চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ১৫ লাখ টন
• বিশ্ববাজারে চালের দাম প্রতি টনে বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ ডলার
• প্রতিদিনের হিসাব মেলাতেই নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন সাধারণরা
• বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত চলবে আমদানি : খাদ্য সচিব
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত মাস থেকে শুরু হয়েছে সরকারিভাবে আমদানি। চলতি মাসে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির প্রক্রিয়া যুক্ত হয়েছে। কিন্তু খুচরা বাজারে চালের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কোনোভাবেই কমছে না।
বিজ্ঞাপন
চালের বাজারে লাগা আগুনে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। চালের দাম কেজিপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ টাকা বাড়ায় প্রতিদিনের হিসাব মেলাতে নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে এসব মানুষকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারিভাবে চালের মজুত একেবারে কমে গেছে। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাজারে এক শ্রেণির সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। ফলে চালের বাজারের আগুন নেভানো যাচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, ছাটাই (সরু) চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, নাজিরশাইল ৬২ থেকে ৬৮ টাকা, চিনিগুঁড়া ৮৮ থেকে ৯৫ টাকা, কাটারি ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে
সরেজমিন রাজধানীর মহাখালী, উত্তরা, আজমপুর এলাকার চালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারিপর্যায়ে আমদানির খবরে চালের দামে তেমন হেরফের হয়নি। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, ছাটাই (সরু) চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, নাজিরশাইল ৬২ থেকে ৬৮ টাকা, চিনিগুঁড়া ৮৮ থেকে ৯৫ টাকা, কাটারি ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত এক মাস আগে যে দাম ছিল একই দামে চাল বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। মোটা চাল কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ছাটাই (সরু) চাল ৫৬ থেকে ৬৪ টাকা কেজি দরে বিক্রির তথ্য সেখানে বলা হয়েছে। যদিও স্থানীয় বাজারের সঙ্গে টিসিবি’র দেওয়া তথ্যে বেশ গরমিল রয়েছে।
চাল আমদানির সিদ্ধান্তটা আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল। এখন বাজারে চালের ঘাটতি রয়েছে। তাই দাম কমতে আরও সময় লাগবে
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক
শুল্ক কমিয়ে আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও কেন চালের দাম কমছে না— প্রশ্ন রাখা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চাল আমদানির সিদ্ধান্তটা আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল। এখন বাজারে চালের ঘাটতি রয়েছে। তাই দাম কমতে আরও সময় লাগবে। কারণ চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখনও বাজারে ওই চাল প্রবেশ করেনি।’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, চালের ঘাটতি থাকার কারণেই বাজারে মূলত অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ঘাটতি পূরণ হলে অস্থিরতা কেটে যাবে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোক্তাপর্যায়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯৪ হাজার টন চালের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার টন চালের ঘাটতি রয়েছে। ফলে বাজারে চালের দামে ঊর্ধ্বগতি। বর্তমানে করণীয় কী— জানতে চাইলে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘চাল আমদানির প্রক্রিয়াটি সচল রাখতে হবে। প্রয়োজনে চাল আমদানিতে শুল্কের পরিমাণ আরও কমিয়ে আনা যেতে পারে। ভারত ও পাকিস্তান থেকে চাল আমদানি করলে বেশি সুবিধা হবে।’
গত এক মাস ধরে প্রতিদিন অল্পপরিমাণ চাল কিনে বাড়ি ফেরেন মহাখালীর রুস্তম আলী। তিনি বলেন, চালের দাম কমার অপেক্ষায় আছি। বেশি দামে চাল কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। উপায় না পেয়ে অল্পপরিমাণ কিনছি।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী বাণিজ্য পরামর্শক (দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল) শ্যামা পদ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বৈঠকে বসবে শিগগিরই। এরপর সিদ্ধান্ত জানা যাবে।’
চাল আমদানির প্রক্রিয়াটি সচল রাখতে হবে। প্রয়োজনে চাল আমদানিতে শুল্কের পরিমাণ আরও কমিয়ে আনা যেতে পারে
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন মনে করেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে চালের বাজারে এমন অস্থিরতা। সরকার চাইলে দাম খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। সঠিক নজরদারির অভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে না।’
উত্তরার আজমপুরের বাসিন্দা রায়হান মনে করেন, এভাবে চালের দাম বাড়তে থাকলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। গত দুই বছরে আয় এক টাকাও বাড়েনি। উল্টো করোনার কারণে অনেকের আয় কমে গেছে। এখন কেজিপ্রতি ১৫ টাকা বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় যাব?’
‘সরকারকে বলব, দ্রুত এ সমস্যার সমাধান দিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে যেন বাঁচিয়ে রাখে’— আকুতি রায়হানের।
কেন চালের দাম বাড়তি
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে হঠাৎ করে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান প্রায় প্রতিদিনই চালের রপ্তানিমূল্য বাড়াচ্ছে। এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম প্রতি টনে ১০ থেকে ১৫ ডলার বেড়েছে। এছাড়া বিশ্বের অন্যতম চাল রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনামও এক যুগ পর এবার চাল আমদানি করছে। এর প্রভাবও পড়েছে বৈশ্বিক চালের বাজারে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমন মৌসুমে দেশে কয়েক দফা বন্যা হয়েছে। এ কারণে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ লাখ টন কম হয়েছে। কমেছে চালের মজুতের পরিমাণও।
বাজার নিয়ন্ত্রণে না থাকায় চালের বাজারে এমন অস্থিরতা। সরকার চাইলে দাম খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। সঠিক নজরদারির অভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে না
এস এম নাজের হোসাইন, ক্যাব সহ-সভাপতি
চালের সর্বশেষ মজুত
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারিভাবে দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুত সাত লাখ ১৯ হাজার টন। এর মধ্যে চালের পরিমাণ ৫ লাখ ৩১ হাজার টন। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১১ লাখ ৫০ হাজার টন। এছাড়া গমের মজুত রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার টন।
৭ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ(কাস্টমস) থেকে জারি করা পৃথক দুই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সব ধরনের চালের আমদানিশুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
৩০০ প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৩ থেকে ১০ জানুয়ারির মধ্যে আবেদন করা ৩০০–এর মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাদের এক মাসের মধ্যে চাল আমদানির শর্ত দেওয়া হয়েছে। গত ১৩ জানুয়ারি ৪৩ প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ছয় হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।
চাল আমদানির শর্তে বলা হয়েছে, বরাদ্দপত্র ইস্যুর সাতদিনের মধ্যে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হবে। এ সংক্রান্ত তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিক ই-মেইলে জানাতে হবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা এক থেকে পাঁচ হাজার টন বরাদ্দ পেয়েছেন, তাদের এলসি খোলার ১০ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ২০ দিনের মধ্যে বাকি চাল বাজারজাত করতে হবে।
বেসরকারিভাবে কত পরিমাণ চাল আমদানি হবে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে যতদিন না বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে ততদিন চাল আমদানি চলবে
ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, সচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয়
এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান পাঁচ হাজার এক থেকে দশ হাজার টন পর্যন্ত বরাদ্দ পেয়েছে, তাদের এলসি খোলার ১৫ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ৩০ দিনের মধ্যে বাকি ৫০ শতাংশ চাল এনে বাজারজাত করতে হবে বলে শর্ত দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। বরাদ্দের অতিরিক্ত আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) ইস্যু করা যাবে না বলেও শর্ত দেওয়া হয়েছে।
চাল আমদানি প্রসঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেসরকারিভাবে কত পরিমাণ চাল আমদানি করা হবে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে যতদিন না বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে ততদিন চাল আমদানি চলবে।
তিনি আরও বলেন, ভোক্তাদের পাশাপাশি কৃষকদের বিষয়ও আমাদের মাথায় রয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব, কখন চাল আমদানি বন্ধ হবে।
গত বছর একই সময়ে বাড়তি ছিল চালের দাম
গত বছরের (২০২০) একই সময়ে চালের দাম ছিল বাড়তি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চিকন চাল বিশেষ করে মিনিকেটের কেজি ছিল ৪৫ টাকা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সেই চাল বিক্রি হয় ৫২-৫৩ টাকা কেজিতে। সাধারণ মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের কেজি ছিল ৪৫ টাকা। জানুয়ারিতে তা বিক্রি হয় ৫৩-৫৪ টাকায়।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওই সময়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসের ব্যবধানে (ডিসেম্বর ২০১৯-জানুয়ারি ২০২০) চালের দাম বেড়েছে পাঁচ শতাংশ। সাধারণ মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের মূল্য বাড়ে ১১.৫৮ শতাংশ।
সুখবর দিচ্ছে কুষ্টিয়ার মোকামগুলো
ঢাকা পোস্টের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, জেলার খাজানগরসহ চালের মোকামগুলোতে কেজিপ্রতি চালের দাম তিন থেকে চার টাকা কমেছে। বিদেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ায় চালের দাম কমেছে বলে জানিয়েছেন মিলাররা।
তারা বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ আগে সবধরনের চালের দাম বাড়তি ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিদেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে চাল এখনও বাজারে আসেনি। কিন্তু এরই মধ্যে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কুষ্টিয়ার বাজারে। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে জেলার চালের মোকাম ও খুচরা বাজারে চালের দাম কমেছে তিন থেকে চার টাকা পর্যন্ত। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলার বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছে। অসদুপায়ে কেউ যদি বাজার অস্থিতিশীলের চেষ্টা করে তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একে/এসএম/এমএআর