করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকা ‘বঙ্গভ্যাক্স’ মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত। অনুমোদনের জন্য গত ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে (বিএমআরসি) আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অনুমোদন পেলে ঢাকার কোনো একটি বেসরকারি হাসপাতালে শ’খানেক স্বেচ্ছাসেবকের ওপর টিকাটি প্রয়োগ করা হবে।  

গ্লোব বায়োটেক বলছে, পুরো ট্রায়াল সম্পন্ন করতে পাঁচ মাস লাগবে। এ মাসে ট্রায়াল শুরু করতে পারলে জুনে আসতে পারে টিকা।   

প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালের আবেদন
গত ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে (বিএমআরসি) ২০টি ফাইলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আবেদন জমা দেওয়া হয়। আবেদনে একসঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রায়ালের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।

গ্লোব বায়োটেকের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ড. আসিফ মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, গ্লোব বায়োটেকের পক্ষে ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও) লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠান এ আবেদন জমা দিয়েছে।

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাবের নেতৃত্বে ৫৭ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল মানবদেহে বঙ্গভ্যাক্সের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ও গবেষণায় অংশ নেবেন।

অনুমোদন পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই ট্রায়াল শুরু করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন ডা. মাহতাব।

আমাদের সম্পূর্ণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করতে পাঁচ মাস সময় লাগবে। যদি আমরা ট্রায়ালটা এ মাসেই শুরু করতে পারি, তাহলে টিকা জুনের মধ্যে পাব। আর যদি এ মাসে শুরু করা না যায়, তাহলে আরও সময় লাগবে।

ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরি অপারেশনের ব্যবস্থাপক, গ্লোব বায়োটেক

কতদিন চলবে ট্রায়াল?
গ্লোব বায়োটেকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফেস ওয়ান এবং ফেস টু- এ দুই ধাপের জন্য ট্রায়ালের অনুমোদনের আবেদন করা হয়েছে। একটি ফেস বা ধাপ শেষ হলে আরেকটি শুরু হবে। একটি ধাপ শেষ করতে হলে ৪০-৪৫ দিন লাগতে পারে। প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর ফেস টু বা দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে। তবে এর মধ্যে তথ্য মূল্যায়নের বিষয় রয়েছে।

কবে আসবে ‘বঙ্গভ্যাক্স’?
গত ৬ জানুয়ারি গ্লোব বায়োটেকের কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরি অপারেশনের ব্যবস্থাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, চলতি মাসে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পারলে টিকা আসতে আরও ৫-৬ মাস লাগবে। আর এ মাসে ট্রায়াল শুরু করতে না পারলে আরও দেরি হবে।

তিনি বলেন, যেকোনো ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন হয়। ২৮ ডিসেম্বর অধিদপ্তর আমাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে। ’সিআরও বাংলাদেশ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান ট্রায়ালটি পরিচালনা করবে। এজন্য তারা কাজ শুরু করেছে। তাদের ট্রায়াল শেষ হলে প্রটোকল অনুযায়ী আমরা টিকা সরবরাহের কাজ শুরু করবো।

ট্রায়াল শেষে টিকা আসতে কতদিন সময় লাগবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সম্পূর্ণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করতে পাঁচ মাস সময় লাগবে। যদি আমরা ট্রায়ালটা এ মাসেই শুরু করতে পারি, তাহলে টিকা জুনের মধ্যে পাব। আর যদি এ মাসে শুরু করা না যায়, তাহলে আরও সময় লাগবে।

২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, তাদের করোনা টিকার তালিকায় বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেকের নাম আছে। যে ১৫৬টি টিকা পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পূর্বাবস্থায় আছে, তার মধ্যে গ্লোবের তিনটি টিকা আছে। এগুলো হলো- ডি৬১৪ ভেরিয়েন্ট এমআরএনএ, ডিএনএ প্লাজমিড ও এডিনোভাইরাস টাইপ-৫ ভেক্টর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য এও জানিয়েছে যে, নভেল করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে তথ্য দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই ল্যান্ডস্কেপ ডকুমেন্টটি তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকাভুক্তির মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট একটি পণ্যের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়া বোঝায় না।

গত বছরের ১৮ অক্টোবর গ্লোব বায়োটেকের গবেষণা ও উন্নয়ন শাখার প্রধান আসিফ মাহমুদ জানিয়েছিলেন, প্রাণীর ওপর তাদের টিকার সফল পরীক্ষা হয়েছে। তারা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওই সময় গ্লোব কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, তারা তিনটি টিকা উদ্ভাবন করেছে।

বিএমআরসি কী বলছে?
বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত অনুমোদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, কোনো আবেদন আসলে সেটি রিভিউয়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়।

এগুলো যেহেতু জরুরি তাই বিশেষজ্ঞদের দ্রুত রিভিউ দিতে বলা হয়। তাদের যদি কোনো বিষয়ে কোনো তদন্ত করার থাকে তাহলে তারা সেটি ইনভেস্টিগেটর বা ট্রায়াল পরিচালনাকারী দলের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠাবে। তারা যত দ্রুত উত্তর দেবে তত দ্রুত এর রিভিউ সম্পন্ন করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা যদি কোনো সমস্যা না দেখেন তাহলে তারা একটি প্রতিবেদন দেন যা বিএমআরসির এথিক্যাল কমিটির কাছে পাঠানো হয়।

এই কমিটি ক্লিয়ারেন্স দিলে সেটি জানিয়ে দেওয়া হয় এবং এরপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাতে পারবে। তবে এরপর বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনেরও একটি অনুমোদন লাগে।

তবে সব কিছু ঠিক থাকলে বিএমআরসির অনুমোদন পেতে সপ্তাহ দুয়েকের মতো সময় লাগে বলে তিনি জানান।

বঙ্গভ্যাক্স’র প্রক্রিয়া যেভাবে শুরু
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে মহামারি এই রোগের জন্য ভ্যাকসিন উন্নয়নের কাজ শুরু করে গ্লোব বায়োটেক।

তখন আন্তর্জাতিকভাবে যেসব জেনোম সিকোয়েন্স ছিল, সেগুলো বিশ্লেষণ করে একটি বিশেষ ধরনের মিউটেশনের খোঁজ পান গ্লোব বায়োটেকের বিজ্ঞানীরা। এই মিউটেশনটি হলো ডি৬১৪ ।

তখন এই মিউটেশনের সংখ্যা খুবই কম ছিল বলে জানান গ্লোব বায়োটেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. কাকন নাগ।

তিনি বলেন, ওই সময়ে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই জেনোম মিউটেশনটি ভবিষ্যতে মারাত্মক প্রভাব তৈরি করবে। তখন তারা এটি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।

ওই সময়ে আসলে কেউ ধারণা করতে পারেনি যে এই স্ট্রেইনটি সারা বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবে, বলেন তিনি।

গ্লোব বায়োটেক বলছে, বর্তমানে সারা বিশ্বে যতগুলো স্ট্রেইন আছে তার মধ্যে ‘ডি৬১৪’ টি ১০ গুণ বেশি সংক্রমক এবং এর বিরুদ্ধে এখনও কেউ ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট তৈরি করেনি।

টিআই/এসআরএস