নিজের নামে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সৈয়দ আহমেদ রোডে রয়েছে বহুতল ভবন, কাঁটাসুরে ৩১ কাঠা জমি ও তাজমহল রোডে ফ্ল্যাট। ব্যক্তিগত প্রাডো ব্র্যান্ডের দুইটি গাড়িসহ রয়েছে আরও কিছু জমির মালিকানা। এছাড়া রয়েছে নামে-বেনামে নগদ টাকা ও ঋণের তথ্য-উপাত্ত।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু নিজেই তার আয়কর বিবরণীতে জানিয়েছেন। তবে এর বাইরেও জাপা নেতা সেন্টুর রয়েছে আরও অনেক সম্পদ, যা পৈত্রিক সূত্রে অর্জন করেছেন বলে দাবি তার। দালিলিকভাবে এসব সম্পত্তির মূল্য অনেক কম দেখানো হলেও বাস্তবে এর মূল্য শত কোটি টাকার বেশি।

আয়কর বিবরণীতে তার দেওয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাবে সন্তুষ্ট নয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির যাচাই-বাছাইয়ে দালিলিকভাবে সেন্টুর সোয়া ২ কোটি টাকার সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংস্থাটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের এমন প্রমাণ পাওয়ায় তাকে স্বনামে ও বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, দায়-দেনা, আয়ের উৎস এবং তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণীসহ সম্পদের হিসাব দাখিল করতে বলেছে দুদক। সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক মুহাম্মদ আরিফ সাদেক ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে সংস্থাটির পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক অনুসন্ধান করে কমিশনের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ মালিক হয়েছেন সেন্টু। তাই নোটিশ পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে তার নিজের, নির্ভরশীল ব্যক্তিদের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, দায়-দেনা, আয়ের উৎস ও তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ নির্ধারিত ফরমে দাখিল করতে বলা হলো।

আদেশে আরও বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি তিনি উক্ত সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে ব্যর্থ হন অথবা মিথ্যা বিবরণী দাখিল করেন, তাহলে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৬(২) ধারা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে দুদক।

দুদকের সম্পদের নোটিশের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম সেন্টু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার যা সম্পদ রয়েছে, তা আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়েছে। রিটার্নের বাইরে আমার কিছু নেই। আমি নির্বাচনে হলফনামা জমা দিয়েছি। সেখানে তো হিসাব দেওয়াই আছে। তারা সম্পদের হিসাব চেয়েছে আমি সম্পদের হিসাব জমা দেবো।

দুদকের কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়া দুই কোটি টাকার বেশি ঋণের বিষয়ে সেন্টু বলেন, আমি যা ঋণ দেখিয়েছি তা ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়েছি। এর স্বপক্ষে সব রেকর্ডপত্র রয়েছে।

আপনাকে হয়রানি করা হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে, দুদক হিসাব চাইতেই পারে। আমার জমা দিতে সমস্যা নেই। আমি তিন বারের কাউন্সিলর। সবসময় হিসাব বিবরণী জমা দিতে হয়। উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে হিসাব জমা দেবো।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দুদকের অনুসন্ধানে শফিকুল ইসলাম সেন্টুর ৪ কোটি ৬২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিপরীতে তার সর্বশেষ আয়কর নথি অনুসারে, নিট সম্পদের পরিমাণ পাওয়া গেছে ১ কোটি ৫১ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৬ টাকা এবং গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ২ কোটি ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৭ টাকা। তবে ২ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকার সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। যে কারণে সম্পদের সঠিক হিসাব প্রদানে দুদক আইনের ২৬ (১) ধারায় সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করা হয়েছে।

দুদক সূত্র আরও জানায়, সেন্টু ২০১৮-১৯ করবর্ষের দাখিলকৃত আয়কর বিবরণীতে মোট ২ কোটি ৮৫ লাখ ৮৫ হাজার ৫০ টাকার দায়-দেনা দেখিয়েছেন। যার মধ্যে নুর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনসের নিকট ঋণ হিসাবে ৪ লাখ, জনৈক দেলোয়ার হোসেন, ইমরান সরকার ও সামসুন নাহারের নিকট থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে ৬০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ, মাসুদ রানার কাছ থেকে ৩০ লাখ, ওবায়দুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ হিসাবে ২০ লাখ, শেখ ফারহানা সাদেকের কাছ থেকে ১৫ লাখ, মনিরুল ইসলামের থেকে ১০ লাখ, আরিফুল ইসলামের কাছ থেকে ১০ লাখ, মাহমুদুল ইসলামের কাছ থেকে ২০ লাখ, পূবালী ব্যাংক থেকে গাড়ি ক্রয়ের ৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকার ঋণ, রেমিট্যান্স হিসাবে ৯ লাখ ৫১ হাজার ৫৪৪ টাকা ও বাসা ভাড়া বাবদ অগ্রিম ৫৪ লাখ টাকার দায় দেখিয়েছেন তিনি।

কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে শফিকুল ইসলাম সেন্টুর আয়কর নথিতে প্রদর্শিত উক্ত ঋণের মধ্যে মোট ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ঋণের যুক্তিসংগত প্রমাণ পায়নি দুদক। এছাড়াও বিদেশ থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স হিসাবে ৯ লাখ  ৫১ হাজার টাকা আয়কর নথিতে দেখিয়েছেন। কিন্তু অনুসন্ধানে উক্ত রেমিট্যান্স প্রাপ্তির বিষয়ে সেন্টু কোনো রেকর্ডপত্র দাখিল করতে পারেননি। তবে পূবালী ব্যাংক থেকে গাড়ি ক্রয়ের ৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকার ঋণ ও বাসা ভাড়া বাবদ অগ্রিম ৫৪ লাখ টাকাসহ মোট ৬১ লাখ ৩৩ হাজার ৫০৬ টাকা ঋণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

স্থাবর সম্পদের মধ্যে সেন্টুর নামে মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ আহমেদ রোডে সাড়ে ৭ কাঠা জমিতে একটি বহুতল ভবন, কাঁটাসুরে ৮ কাঠার দুটি প্লট ও ২৩ কাঠার একটি বিশাল জমি এবং তাজমহল রোডে ৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রাডো ব্র্যান্ডের দুইটি গাড়ির মালিক তিনি।

২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের ২০০ জনের তালিকা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি।

ওই সময় দুদকে অভিযোগ আসে, শফিকুল ইসলাম ঢাকার ক্লাব পাড়ায় প্রথমে জুয়ার বোর্ড চালু করেন। বিভিন্ন ক্লাবে কমিটির কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে জুয়ার বোর্ড চালাতেন সেন্টু। ২০১৬ সালে প্রথম অত্যাধুনিক যন্ত্র এনে ধানমন্ডির কলাবাগান ক্রীড়া চক্রে ক্যাসিনো চালু করেন তিনি।

অভিযোগ যাচাইয়ে ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শফিকুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল। দলের অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. সালাহউদ্দিন, গুলশান আনোয়ার প্রধান, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, আতাউর রহমান ও মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী।

আরএম/এসকেডি/ওএফ