দিন দিন অসহনীয় হয়ে ওঠা রাজধানীর যানজট নিরসনে পরীক্ষামূলক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালে হাতে নেওয়া ওই প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর সড়কে বসানো হয় কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি। প্রকল্পে ব্যয় হয় ৫২ কোটি আট লাখ ৪৮ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু সময় ও খরচ বাড়লেও আলো ফোটেনি কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতির!

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) প্রকল্পের কাজ শুরুর পর রাজধানীতে তৈরি হয়েছে বাড়তি ভোগান্তি। যান চলাচলে শৃঙ্খলায় সিটি করপোরেশন কর্তৃক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে চার দফায় স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থাও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার না হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে। এর মধ্যেই বিশেষজ্ঞদের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও রাজধানীর সড়কে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি’ বসানোর প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।

এ বাতি নিজ থেকেই গাড়ির সংখ্যা শনাক্ত করে সংকেতের জন্য সময় নির্ধারণ করবে। গাড়ির সংখ্যা বুঝে ট্রাফিক সিগন্যাল চালু ও বন্ধ করার সংকেত দেবে সেন্সর ক্যামেরা ডিভাইস। ২৫০ মিটার এলাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি কাভার করতে পারবে
রাজধানীর যানজট নিরসনে পরীক্ষামূলক কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি বসানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় / ছবি- ঢাকা পোস্ট

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি চালু করতে জাপানি প্রতিষ্ঠান ‘নিপ্পন কই’ (Nippon Koei Bangladesh Ltd.) থেকে ক্রয় করা হয় প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি। এর মধ্যে রয়েছে- সিগন্যাল মেইনটেন্যান্স (সংকেত রক্ষণাবেক্ষণ) সরঞ্জামাদি, সিসিটিভি, ইমেজ ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, হাই রেজুলেশনের আল্ট্রা-সনিক ভেইকেল ডিটেকটিভ ডিভাইস, ক্যাবল (তার) ও বিশেষ পোল (খুঁটি)। বসানো হয় সিগন্যাল পোস্ট, লাগানো হয় উচ্চ আলো ছড়ানোর লাইট। কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে পুলিশের ওপর। সবকিছু দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুই সিটি করপোরেশনকে।

প্রকল্পের কাজও শুরু করে জাপানি প্রতিষ্ঠান কিওসান (Kyosan)। কিন্তু ঢাকা এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ এবং ডিএনসিসি’র ‘তারের জঞ্জাল’ অপসারণ অভিযানে থমকে পড়ে প্রকল্পটি। চুরি হয়ে যায় কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতির সার্ভার মেশিনও। অব্যবহৃত অবস্থায় সড়কে লাগানো ক্যামেরা ও বাতিগুলো আস্তে আস্তে নষ্ট হতে থাকে।

রাজধানীর যানজট নিরসনে পরীক্ষামূলক কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি বসানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় / ছবি- ঢাকা পোস্ট

 

ঢাকা এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ এবং ডিএনসিসি’র ‘তারের জঞ্জাল’ অপসারণ অভিযানে থমকে পড়ে প্রকল্পটি। চুরি হয়ে যায় কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতির সার্ভার মেশিনও। অব্যবহৃত অবস্থায় সড়কে লাগানো ক্যামেরা ও বাতিগুলো আস্তে আস্তে নষ্ট হতে থাকে

ডিটিসিএ সূত্রে জানা গেছে, ইন্টেগেরেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে পাইলট প্রজেক্টের আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর গুলশান, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত মোড়ে এ ‘কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি’ স্থাপন করা হয়।

কর্মকর্তারা বলছেন, এ বাতি নিজ থেকেই গাড়ির সংখ্যা শনাক্ত করে সংকেতের জন্য সময় নির্ধারণ করবে। গাড়ির সংখ্যা বুঝে ট্রাফিক সিগন্যাল চালু ও বন্ধ করার সংকেত দেবে সেন্সর ক্যামেরা ডিভাইস। ২৫০ মিটার এলাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি কাভার করতে পারবে।

রাজধানীর তীব্র যানজট নিরসনে প্রকল্পটি হাতে নেয় ডিটিসিএ। তাদের অভিযোগ, ডিএনসিসি ক্যাবল কেটে দেওয়ায় সময় মতো কাজ শেষ হয়নি / ফাইল ছবি

যে কারণে থমকে যায় প্রকল্পটি
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের মেয়াদ অনুযায়ী ‘কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি’ চালুর কথা ছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু জাপান থেকে কেনা অর্ধ কোটি টাকার সার্ভার কম্পিউটার চুরি হয়ে যায়। এরপর সেটি পুনরায় কেনা হলেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ‘তারের জঞ্জাল’ অপসারণের নামে ডিশ ও ইন্টারনেট ক্যাবলের সঙ্গে ডিটিসিএ’র কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি স্থাপন প্রকল্পের গুলশান ও মহাখালীর প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের তার কেটে নিয়ে যায়। এরপর আর বিষয়টির সুরাহা হয়নি। ফলে থমকে যায় প্রকল্পের কাজ। পরীক্ষামূলক চালু করা প্রকল্পটি সাত বছরেও আলোর মুখ দেখেনি।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও আলোর মুখ দেখেনি কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি বসানো প্রকল্প / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক (টিএমপিটিআই) মোহাম্মদ রবিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ সড়কবাতিগুলো সাধারণ সড়কবাতি থেকে আলাদা। সাধারণ সিগন্যাল বাতিগুলোতে কত সেকেন্ড পর সবুজ বাতি বা লাল বাতি জ্বলবে, তার সময় নির্ধারণ থাকে। এখানে সময় নির্ধারণ করা থাকে না।

কেন সময় নির্ধারণ করা থাকে না— এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেমের (আইটিএস) ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাগুলোর মূলত দুটি কাজ। এক. সড়কে থাকা গাড়ির সংখ্যা শনাক্ত করা। আর আড়াই থেকে তিনশ মিটার দূর পর্যন্ত সড়কে থাকা যানবাহনের ইমেজ ধারণ করা। দুই. কোন লেনে কত সংখ্যক যানবাহন তার সংখ্যা গুনে নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত দেওয়া যে, কোন দিকে গাড়ি চলাচলের জন্য বা বন্ধের জন্য বাতি জ্বালাতে হবে।’

কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি বসানো প্রকল্পে ব্যয় হয় ৫২ কোটি আট লাখ ৪৮ হাজার টাকা / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

রবিউল আলম বলেন, রাজধানীর চার স্থানেই (গুলশান, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া) ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেমের (আইটিএস) ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, সিগন্যাল মেইনটেন্যান্স সরঞ্জামাদি, ইমেজ ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, হাই রেজুলেশনের আল্ট্রা-সনিক ভেইকেল ডিটেকটিভ ডিভাইস, ক্যাবল পোল, সিগনাল পোস্ট ও উচ্চ আলোর লাইট ক্রয় ও স্থাপন করা হয়। বাকি ছিল সমন্বয়ের কাজ (অ্যাডজাস্টমেন্ট)। করোনার কারণে সে কাজ পিছিয়ে যায়। এর মাঝে একটি সার্ভার কম্পিউটার হারিয়ে যায়। সেটিও পুনঃক্রয় করা হয়। কিন্তু ডিটিসিএ’র আপত্তি সত্ত্বেও কয়েক কোটি টাকার ক্যাবল (তার) গণ-অভিযানের নামে কেটে নিয়ে যায় উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। যে কারণে আর চালু করা যায়নি কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন সড়কবাতি।

ডিএনসিসি ক্যাবল কিনে না দিলে কিংবা ফিরিয়ে না দিলে এ প্রকল্প কি থমকে যাবে— জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমরা বারবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কিন্তু ডিএনসিসি আমাদের শুধু ঘোরাচ্ছে। এখন এ প্রকল্প কবে নাগাদ ফের চালু করা সম্ভব, তা বলা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় সমস্যা সম্পর্কে অবগত।’

প্রকল্পটির জন্য জাপান থেকে কেনা অর্ধ কোটি টাকার সার্ভার কম্পিউটারও চুরি হয়ে যায়। এটিও প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ডিটিসিএ’র ক্যাবল (তার) ফেরত দেওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় ডিএনসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজার সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে ডিএনসিসি তার বা ক্যাবল কাটে না। সড়কে ঝুলন্ত থাকা তার কাটার ক্যাম্পেইন চলমান। আমরা তাদের তার কাটব কেন? যদি কোনো প্রজেক্ট করতে গিয়ে তাদের ক্যাবল কাটা পড়ে, সেটা তো সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরা খতিয়ে দেখব।’

অযৌক্তিক, নির্বুদ্ধিতার প্রকল্প : অধ্যাপক শামসুল হক
পুরো প্রকল্পটি অযৌক্তিক, নির্বুদ্ধিতার প্রকল্প। কমার্শিয়াল ইন্টারেস্টের জায়গা থেকে এটি করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকার মতো রাজধানীতে এমন প্রকল্পের কোনো যৌক্তিকতা নাই, বিজ্ঞানের কাছাকাছিও নাই। বিজ্ঞানের অপব্যবহার হলো এ প্রকল্প। রাজধানী ঢাকায় যে পরিমাণ চাপ (গাড়ির চাপ), সেখানে এ প্রজেক্ট ব্যর্থ হতে বাধ্য। কমার্শিয়াল ইন্টারেস্টের জায়গা থেকে এটা করা হয়েছে। যারা টাকা দিচ্ছে তাদের যেমন কমার্শিয়াল ইন্টারেস্ট আছে, তেমনি যারা প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে তাদেরও ব্যক্তিস্বার্থ রয়েছে। বুদ্ধিদীপ্ত কাজের জন্য যে ধরনের পূর্বশর্ত মানতে হয়, সেটার পরিবেশ তো ঢাকায় নাই। নির্দ্বিধায় বলতে পারি এ প্রজেক্ট অযৌক্তিক। আগে নেওয়া এমন অনেক প্রজেক্ট ব্যর্থ হয়েছে।’

অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, জবাবদিহিতা নাই বলেই এমন প্রজেক্ট হাতে নেওয়া যায়। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখে না, মুখ থুবড়ে পড়ে। এমন উদাহরণ অনেক আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অতীতে এমন কোনো প্রজেক্ট সফল হয়নি। আরও দুর্ভাগ্যজনক যে, অতীতে বাস্তবায়িত প্রজেক্টগুলো কেন সফল হয়নি, তার মূল্যায়নও করা হয়নি কখনও।

সড়কের যা-তা অবস্থা। পরিবহন সংখ্যাও অনেক। ফুটপাত দখল, ফুটপাতে অবৈধ স্থাপনা— অর্থাৎ পুরো সিস্টেমকে যদি আপনি ঠিক না করেন তাহলে তো আপনি কোনো উদ্যোগই বাস্তবায়ন করতে পারবেন না— মনে করেন এ পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। 

জেইউ/এমএআর/