বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস, যাকে সংক্ষেপে বিসিএস বলা হয়। শিক্ষার্থীদের কাছে যেন এক স্বপ্নের নাম। প্রিলি ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করার পর চূড়ান্তভাবে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যেন তাদের কাছে বিশ্ব জয়ের সমান। সেখানে চূড়ান্তভাবে স্বপ্নের এই বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগ না পাওয়া যেন মেধাবী তরুণের স্বপ্নভঙ্গের একটি কাব্য।

৪২তম বিসিএস (বিশেষ), পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল অনুযায়ী মোট ৫ হাজার ৯১৯ জন উত্তীর্ণ হলেও বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কাছে পদ স্বল্পতার কারণে ৪ হাজার জনকে ‘সহকারী সার্জন’ পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে অবশিষ্ট ১ হাজার ৯১৯ জনকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর বলছে সারাদেশে প্রায় ১১ হাজারের বেশি চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। এ অবস্থায় পরীক্ষায় কৃতকার্য এসব শিক্ষার্থীদের একটাই প্রশ্ন- উত্তীর্ণ হয়েও কেন তারা নিয়োগ বঞ্চিত?

সিলেট ইউমেন্স মেডিকেল কলেজের ২০১১-১২ সেশনে এমবিবিএস পাস করেন ডা. সুমা রাণী দাস। পরিবারের সদস্যদের আকাঙ্ক্ষা এবং নিজের কল্পনায় আঁকা স্বপ্নের সারথি হতে অংশগ্রহণ করেন ৪২তম বিসিএসে। পড়াশোনায় নিজের সেরাটা দিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষায় কৃতকার্যও হন। কিন্তু অদৃশ্য এক কারণে উত্তীর্ণ হয়েও তিনি নিয়োগ পাননি।

আক্ষেপ জানিয়ে নিয়োগ বঞ্চিত ডা. সুমা রাণী দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিএসসি আমাদের চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ করেছে, এখন আবার বলছে পদ স্বল্পতার কারণে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না! কিন্তু গত কিছুদিন আগেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় জানিয়েছেন, সারাদেশে ১১ হাজারের বেশি চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। তাহলে কি আমাদের নিয়ে ছেলে-খেলা করা হচ্ছে না?

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বর্তমান সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আমরা জানি যে ২০১০ সালের আগে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই নিম্নমানের ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রান্তিক পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা পৌঁছানোর জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তবে করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। করোনায় আমরা অনেক চিকিৎসককে হারিয়েছি। করোনার পাশাপাশি স্বাভাবিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চলমান রাখতে গিয়ে হাসপাতালগুলোতে জনবল সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা মনে করি, এ নিয়োগ বঞ্চিত চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া হলে জনবল সংকট অনেকটাই লাঘব হবে।

ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও নিয়োগ প্রত্যাশী ডা. আজিজুল আহাদ নিলয় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মনে করি এক হাজার ৯১৯ জন চিকিৎসককে দ্রুতই নিয়োগ দেওয়া জরুরি। কারণ, আমরা জানি যে করোনায় এ পর্যন্ত দেশে ১৮৬ জনের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মারা গেছেন। এছাড়াও করোনা উপসর্গ নিয়ে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জনের মতো চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে, কিছুটা হলেও দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পাশাপাশি সাধারণ চিকিৎসকদেরও সংকট তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সংকটের কারণে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সেবাদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ৪২তমের আগের বিসিএসে যেসব চিকিৎসক নিয়োগ হয়েছে, তারা তাদের চাকরির প্রায় দুই বছর পূর্ণ করেছে। তারা এ বছরের ডিসেম্বর মাসেই প্রেষণে বা ডেপুটেশনে চলে যাবেন এবং তারা বিভিন্ন ডিগ্রির অধীনে কোর্স শুরু করবেন। যে কারণে উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকের সংকট দেখা দিচ্ছে।

ডা. নিলয় আরও বলেন, মাত্র চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিলেই যে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনরায় ফিরে আসবে এবং চিকিৎসক সংকট শেষ হয়ে যাবে, এটা বলা যায় না। কারণ, চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার পরও প্রায় পাঁচ হাজার চিকিৎসকের পদ খালি থাকে। আমি মনে করি এ শূন্য পদগুলোতে আমরা যারা বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছি তাদের নিয়োগ দিয়ে চিকিৎসক সংকট সমস্যা সমাধান করে স্বাস্থ্য সেবাকে আরও গতিশীল করা জরুরি।

মুন্নু মেডিকেল কলেজের ডা. রনি চন্দ্র দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিসিএস একজন শিক্ষার্থীর জীবনে একটা স্বপ্ন। আমরা বিসিএসের সমস্ত ধাপ অতিক্রম করে চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। এ পর্যায়ে এসে যদি আমরা নিয়োগ বঞ্চিত হই, তাহলে সেটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়।

তিনি বলেন, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এডহক, ৩৩তম বিসিএস ও ৩৯তম বিসিএস এর মাধ্যমে ১৮ হাজারের অধিক চিকিৎসক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সমযোপযোগী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের মাধ্যমেই দেশে শিশু মৃত্যুহারের পাশাপাশি মাতৃ মৃত্যুহার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে, বেড়েছে দেশের মানুষের গড় আয়ু এবং এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও সম্ভব হয়েছে। আমরাও যদি নিয়োগপ্রাপ্ত হই তাহলে দেশের যে কোনো প্রান্তে চিকিৎসা সেবা দিতে চাই।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু আমাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো, হাসপাতাল-স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এখনও চিকিৎসক পদ শূন্য আছে, সেই প্রেক্ষাপটে সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাইলে ৪২তম বিসিএস থেকে নিয়োগ বঞ্চিতদের এনে নিয়োগ দিতে পারে। এমনকি চাইলে তাদের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি পিএসসিতে (বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন) চাহিদাপত্র পাঠায় যে ৪২তম বিসিএস থেকে আমাদের আরও চিকিৎসক নেওয়ার সুযোগ আছে ও হাসপাতালগুলোতে আমাদের চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে, এগুলোতে জনস্বার্থে আমরা পদায়ন দিতে চাই, তাহলেই পিএসসি এ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্যই পিএসসিতে রিকমেন্ডেশন (সুপারিশ) পাঠাতে হবে। আর তাহলেই আমার মনে হয় নিয়োগ না পাওয়াদের থেকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব।

তিনি বলেন, যদি হাসপাতালগুলোতে এ চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নাই হয়, সেক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে। যেমন- কৃষি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, এমনকি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ও চাইলে পুলিশ হাসপাতালে এই চিকিৎসকদের নিয়োগ দিতে পারে।

পিএসসি নিজ উদ্যোগে এই চিকিৎসকদের নিয়োগ দিতে পারে কি-না -এমন প্রশ্নের জবাবে এই চিকিৎসক নেতা বলেন, পিএসসি চাইলেই তাদের নিয়োগের সুপারিশ করতে পারে। এক্ষেত্রে পূর্বে যেমনটা বললাম যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন হাসপাতাল ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধীন তাদের নিয়োগের সুযোগ আছে। অর্থাৎ পিএসসি চাইলেই ৪২তম বিসিএস থেকে চিকিৎসকদের নিয়োগের সুপারিশ করতে পারে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় আমরা যে কোয়ালিটি হেলথ বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট কোয়ালিটি রোলের কথা বলি, সেখানে সর্বাগ্রেই চলে আসে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার মত জনগণ এবং চিকিৎসকদের যে রেশিও সে অনুপাতে আমাদের দেশে চিকিৎসক স্বল্পতা রয়েছে। বিষয়গুলো আমরা বারবার সরকারের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি যে, আপনারা যদি কোয়ালিটি হেলথ দিতে চান তাহলে অবশ্যই চিকিৎসক সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, আপনারা জানেন ৪২তম বিসিএসে একই সংখ্যক চিকিৎসক নেওয়ার পরে বাকি দুই হাজারের মতো চিকিৎসক। তাদের পাবলিক সার্ভিস কমিশন উত্তীর্ণ দেখিয়ে অপেক্ষমাণ তালিকা রেখে দিয়েছে। এর পরবর্তী সময়ে সরকার কিছু চিকিৎসককে যোগদান করিয়েছেন, কিন্তু প্রায় দুই হাজার চিকিৎসকের ভাগ্যে যোগদান জোটেনি। পিএসসি থেকে যদি কাউকে উত্তীর্ণ করে রেখে দেওয়া হয় পরবর্তী পর্যায়ে যদি তারা আবারও নতুন করে নিয়োগ পরীক্ষা নেয় তাহলে সঙ্গত কারণেই ধরে নেওয়া যায় যে উত্তীর্ণ চাকরি প্রত্যাশীদের আগে চাকরি দেওয়া হবে এবং পরে নতুনরা নিয়োগ পাবে।

ডা. এহতেশামুল হক বলেন, সরকারের কাছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম দাবি হলো স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কোয়ালিটি স্বাস্থ্য সেবা পেতে হলে প্রচুর সংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। আর দ্বিতীয় দাবি হলো, কোয়ালিটি স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য যদি চিকিৎসক নিয়োগ করা হয় তাহলে যেন অবশ্যই পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে ইতিমধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে আছেন তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে করে তারা যে মানবেতর জীবন যাপন করছে, পারিবারিক এবং মানসিকভাবে তারা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা কিছুটা পুষিয়ে ওঠা যাবে।

বিএমএ মহাসচিব বলেন, করোনায় এ পর্যন্ত দেশে শুধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই মারা গেছেন ১৮৬ জন এবং সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জন ডাক্তার মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে, কিছুটা হলেও দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পাশাপাশি সাধারণ চিকিৎসকদেরও সংকট তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সংকটের কারণে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সেবাদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই অবস্থায় হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা আরও বলেন চিকিৎসক নিয়োগ জরুরি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের এইচআরআইএস রিপোর্টের গত ৫ সেপ্টেম্বরের তথ্যানুযায়ী, শুধু স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই চিকিৎসকের পদশূন্য রয়েছে ৫ হাজার ৮৪৮টি। এদিকে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২১ এর স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা অধ্যায়ের সূচক অনুযায়ী, ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত হচ্ছে ১:১৭২৪ অর্থাৎ প্রতি ১৭২৪ জন মানুষের জন্য ডাক্তার আছেন মাত্র ১ জন। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত ১:১০০০ থাকা উচিত বলে মনে করা হয়।

টিআই/এসএস