রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। কোথাও মেট্রোরেল, এলিভেটর এক্সপ্রেসওয়ে, কোথাও বিদ্যুৎলাইন, কোথাও মাটির নিচে নেওয়া হচ্ছে ঝুলন্ত তার, আবার কোথাও সুয়েজ লাইন, কখনও ওয়াসার পানির লাইন সংস্কারে চলছে এই খোঁড়াখুঁড়ি। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সড়কে সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ির ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মূল সড়ক, অলিগলিসহ প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার সড়ক রয়েছে রাজধানীতে। এরমধ্যে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থাই খারাপ। বিভিন্ন সময় এসব সড়কে উন্নয়নের কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এছাড়া মেট্রোরেল, এলিভেটর এক্সপ্রেসওয়ে, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ওয়াসার লাইন, ডিপিডিসি, বিটিআরসি, ডেসকো, তিতাসসহ সেবা সংস্থার কাজ বছর জুড়ে লেগেই আছে। সমন্বয়হীনতার অভাবে রাজধানীর একই সড়কে বারবার খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলমান রয়েছে। 

সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির জন্য দুই সিটি করপোরেশনের একটি নীতিমালা রয়েছে যেটা অনুসরণ করে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেওয়ার কথা। অথচ এসব নীতিমালা অনুসরণ না করেই প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে যত্রযত্র খোঁড়াখুঁড়ি করা হচ্ছে। এতে করে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। 

রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সড়কের এক অংশ খুঁড়ে কাজ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে রাস্তা পারাপারসহ সার্বিক দিক থেকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এই এলাকার বাসিন্দাদের। 

স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, পুরো রাজধানী জুড়ে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির উৎসব চলছে। বিভিন্ন কাজের জন্য এক রাস্তা একাধিকবার খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। বিভিন্ন সেবা সংস্থা তাদের কাজের জন্য একবার রাস্তা খুঁড়ে কাজ করে, আবার কিছুদিন পর অন্য সংস্থা তাদের কাজের জন্য আবার একই সড়ক খোঁড়ে। এতে এলাকাবাসীকে খুব সমস্যা এবং ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাদের মধ্যে যদি সমন্বয় থাকত তাহলে এক রাস্তা বারবার খোঁড়া হতো না। একবার রাস্তা খুঁড়লে যাদের যাদের কাজ আছে তারা যদি একবারে করে ফেলতো তাহলে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আসলে তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।

তিনি আরো বলেন, আমাদের এই রামপুরার এলাকার সড়কে কেটে রাখা হয়েছে অনেক দিন হলো। এতে করে উন্নয়নের ভোগান্তিতে পড়েছি আমরা। সামান্য বৃষ্টি হলেই এই কাটা সড়কে পানি জমে যায়। রাস্তা পারাপার হওয়া যায় না। আর মাটি কাঁদা হয়ে থাকে সব সময়। কয়েক মাস আগেও কিন্তু একই সড়কে অন্য কোন সেবা সংস্থা তাদের কাজ করে গেছে। সেময়ই যদি এই কাজগুলো একবারে করে নেওয়া হতো, তাহলে আমাদের এই ভোগান্তি আর পোহাতে হতো না। সমন্বয়হীনতার ফলে ইতোমধ্যে অনেক রাস্তায় কাজ করার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। 

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় মধ্যে বিভিন্ন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির জন্য প্রায় পাঁচশর বেশি আবেদন ইতোমধ্যে জমা পড়েছে। এরমধ্যে অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিবেচনা করে এক তৃতীয়াংশ কাজের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাস্তা কাটা পড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী।

রাজধানীর পশ্চিম ধোলাইপাড় এলাকার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের এলাকায় রাস্তা কেটে ড্রেনের লাইন ঠিক করার কাজ চলছে। আমার একটা দোকান আছে সড়কের পাশে। রাস্তা কাটা থাকায় ব্যবসার বারোটা বেজে গেছে। কাস্টমারও আসে না, বেচা-বিক্রিও সেভাবে হয় না। রাজধানীতে একই রাস্তা বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় উন্নয়ন কাজের জন্য। আমরা উন্নয়নের ভোগান্তি পোহাতে রাজি আছি। তবে এক রাস্তা যেন একবারই কাটা হয়।

এছাড়া দুই সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে মেট্রোরেল, এলিভেটর এক্সপ্রেস ওয়ের জন্যও রাজধানীর একটি বড় অংশ জুড়ে সড়ক বা চলাচলের বেহাল দশা সৃষ্টি হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরেই। নগরবাসীদের মতে, এগুলো উন্নয়ন কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করে চলাচল নির্বিঘ্ন করতে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। 

সড়কে এমন খোঁড়াখুঁড়ি সহ সমসাময়িক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা শীর্ষক এক সেমিনার করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স। সেখানে পরিকল্পনাবিদরা উল্লেখ করেছেন, উন্নয়ন প্রকল্প, খোঁড়াখুঁড়ি ও জনভোগান্তি দূরীকরণে সড়ক খনন নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ প্রয়োজন। পাশাপাশি নির্মাণ অব্যবস্থাপনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা, অযোগ্য ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করা অনতিবিলম্বে প্রয়োজন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প, খোঁড়াখুঁড়ি ও জনভোগান্তি রোধে সড়ক খনন নীতিমালা থাকলেও সেটা উপেক্ষিত। নীতিমালায় জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত খননকাজ পরিহার করার কথা উল্লেখ থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আন্তঃসংস্থা সমন্বয় নেই, সিটি করপোরেশনের কাছে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রদানের কথা বলা থাকলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না।জনভোগান্তি কমাতে এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি গ্রুপের সাথে সেবা সংস্থার আলোচনা ও করণীয় নির্ধারণ, সড়ক খনন নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ, নীতিমালা অনুযায়ী ‘ওয়ান স্টপ’ সমন্বয় সেল এবং সিটি করপোরেশনের অঞ্চলভিত্তিক কয়েকটি ‘মনিটরিং সেল’ কার্যকর করা প্রয়োজন। 

এদিকে রাজধানীর সৌন্দর্য নষ্ট করা ঝুলন্ত তার অপসারণ করে মাটির নিচে প্রতিস্থাপনের কাজ করছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)। এতে করেও রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক খোঁড়া হয়েছে।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এম এ হাকিম এ বিষয়ে বলেন, তার অপসারণে এনটিটিএন এর সঙ্গে আমাদের কাজ চলছে। আমরা ঢাকা মেট্রো সিটির মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় আমাদের বেশ কিছু কাজ করেছি। ঢাকা সিটিতে যে পরিমাণ বিল্ডিং আছে এগুলো কিন্তু আনপ্ল্যানড ওয়েতে এগিয়েছে। আমাদের এ কাজ করতে আরও সময় দিতে হবে। যে কারণে এ বিষয়ে আরও বেশ কিছু সময় নগরবাসীকে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হবে।

রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং জনদুর্ভোগ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নগরজুড়েই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। উন্নয়নের স্বার্থে এসব কাজ করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু খোঁড়াখুঁড়ির এসব কাজের জন্য সেবা সংস্থাগুলোর একে অপরের মধ্যে অবশ্যই সমন্বয় থাকতে হবে। বিভিন্ন কাজের জন্য এক রাস্তা যেন বারবার খোঁড়া না হয়। এতে করে এলাকাবাসী, পথচারী, সাধারণ মানুষের যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তেমনি বারবার খোঁড়াখুঁড়িতে আর্থিক অপচয় হয়। আমরা আশা করব অতিদ্রুত এসব খোঁড়াখুঁড়ি করা রাস্তার কাজ শেষ করে জনগণের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সেবা সংস্থাগুলো জরুরিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

সম্প্রতি সড়কসহ উন্নয়নকাজ পরিদর্শনকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এই বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঢাকাকে পুঁজি করে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ দিনে দিনে বৃদ্ধি করছে। আমি আবারও সকলকে অনুরোধ করব তাদের পরিকল্পনা প্রণয়নের আগেই যেন আমাদের সাথে সমন্বয় করেন। মহাপরিকল্পনার আওতায় আমাদের কার্যক্রমের সাথে সমন্বয় করেই যেন তারা প্রকল্প নেন।

এএসএস/এইচকে