দেশ কৃষিতে অনেক এগিয়ে গেলেও সঠিক পরিসংখ্যানের ঘাটতিতে কৃষির অর্জন ম্লান হচ্ছে। বাজারে কৃষিপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম, চাহিদার বিপরীতে ঘাটতিসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে।

বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) ও বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ৫০ বছর কৃষির রূপান্তর ও অর্জন শীর্ষক কৃষি সম্মেলনে বক্তারা এ কথা বলেন। রোববার (২৪ অক্টোবর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দিনব্যাপী এ কৃষি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

দুই অধিবেশনে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ও বিশেষ অতিথি ছিলেন ইউএসএআইডি বাংলাদেশের মিশন ডিরেক্টর ক্যাথরিন ডেভিস স্টিভেন্স। দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।

প্রথম অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এফএও এর কান্ট্রি রিপ্রেজেনটিভ রবার্ট ডি সিম্পসন, এসিআই এগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ড. এফ এইচ আনসারী, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান, আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন।

দ্বিতীয় অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম। এ সময়ে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রাণীসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম, মৎস্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আরিফ আজাদ, মাল্টি মোড গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা ও আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান।

সঠিক পরিসংখ্যানের গুরুত্ব তুলে ধরে দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আমাদের পরিসংখ্যানে ঝামেলা আছে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গত বছর ১ কোটি ৬ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছিল। আমাদের চাহিদার কথা বলা হয়, ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। এ হিসাবে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন আলু বাড়তি থাকার কথা। সে সময়ে রফতানি বন্ধ ছিল। তারপরও আমাদের ঝামেলা হয়েছিল। তখন আমরা বুঝতে পারিনি প্রকৃতপক্ষে আমাদের উৎপাদন কম হয়েছে না চাহিদা বেশি ছিল। এ হিসাবটা আমাদের সঠিকভাবে আসেনি।

পেঁয়াজের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ থেকে ২৫ লাখ টনের মতো। এর বিপরীতে আমাদের উৎপাদন হয়েছে ৩০ লাখ টনের বেশি। তারপরও আমদানি করতে হয়। কারণ মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ২০ ভাগ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। আবার যেটুকু আমদানি করতে হয় তার ৯০ ভাগ পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। ভারতে যখন সমস্যা তৈরি হয় আমাদের দেশেও একই সমস্যা দেখা দেয়। এখানে আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি চাহিদার সঠিক হিসাবটাও থাকা দরকার। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেই মূলত পেঁয়াজ নিয়ে সমস্যাটা হচ্ছে। এ সময়ে পেঁয়াজের উৎপাদন করা যায় কি না এবং উৎপাদিত পেঁয়াজের যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না সে বিষয়ে কাজ করার দরকার আছে।

টিপু মুনশি বলেন, মাছে আমাদের ব্যাপক বিপ্লব হলেও গরুর মাংস বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এখানে আমরা যদি আমদানির অনুমতি দেই তাহলে দেশের ডেইরি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্যে ভোক্তাদের একটু কষ্ট হলেও আমরা স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছি।

উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, করেনা মহামারি সত্ত্বে ও এ দেশের মানুষ না খেয়ে নেই। এ সময়ে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যের যোগান দেওয়া এবং কৃষির আধুনিকায়ন করা।

চাল বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রতি প্রায় ২০০ গ্রাম চাল খেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে চাল খাওয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০০ গ্রাম। এটা কমিয়ে আনতে পারলে আমাদের যে চালের উৎপাদন সেটাকে টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

তিনি বলেন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য রফতানি করে বড় আয় করে। কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে হবে। এ জন্যে কৃষির আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আমাদের কৃষিতে বৈচিত্র্যায়ন হয়েছে, বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু এ কথা ঠিক এখনো আমরা আমাদের সমমানের দেশগুলো যেমন ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছি।

তিনি আরও বলেন, সরকার কৃষির উন্নয়নে বিশেষ করে ধানের ক্ষেত্রে প্রচুর সহযোগিতা দিচ্ছে। তারপরেও আমাদের উৎপাদনশীলতা অনেক কম। আমরা যখন হেক্টরপ্রতি ২.৪৪ টন চাল উৎপাদন করছি সেখানে একই পরিমাণ জমিতে ভিয়েতনাম ৫.৯ টন চাল উৎপাদন করছে। অর্থাৎ আমরা প্রযুক্তিগতভাবে অনেক পিছিয়ে আছি। যেটা পেঁয়াজ রসুনের আকার দেখলেই বুঝা যায়। এসডিজি লক্ষ্য মাত্রা পূরণ করতে হলে আমাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করতে হবে। ফসলের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে।

একে/এসকেডি