সচিবালয়ের চারপাশকে ২০১৯ সালে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা দেয় সরকার। তবে সেই ঘোষণা আছে শুধু কাগজে-কলমেই। বাস্তবে তার রেশমাত্রও নেই। জিরো পয়েন্ট, পল্টন মোড় ও সচিবালয় লিংক রোড হয়ে আবার জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এলাকায় নিয়মিতই সরব গাড়ির হর্ন। নীরব ঘোষণার পর ওই এলাকায় কিছুদিন পরিবেশ অধিদফতর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। সেই পদক্ষেপও এখন আর চোখে পড়ে না।

২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে সচিবালয়ের চারপাশ অর্থাৎ জিরো পয়েন্ট, পল্টন মোড়, সচিবালয় লিংক রোড হয়ে আবার জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। হর্ন বাজালে বিধান অনুযায়ী শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলেও মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল।

২০০৬ সালের শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী নীরব এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা থাকবে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল। ওই বিধিমালার ধারা ৮ (২) অনুযায়ী, নীরব এলাকায় নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে হর্ন বাজালে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

এ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথম অপরাধের জন্য কমপক্ষে এক মাস কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। পরবর্তী অপরাধের জন্য কমপক্ষে ছয় মাস কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

গত সপ্তাহের রোববার (২৪ অক্টোবর) থেকে বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) মোট পাঁচ দিন সচিবালয় এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শাস্তির বিধান থাকলেও নিয়ম মানছেন না যানবাহন চালকরা। অহেতুক হর্ন বাজাতে দেখা যায় তাদের। এ কারণে নীরব ঘোষিত এলাকাটিতেও অতিরিক্ত শব্দ দূষণ হতে দেখা যায়।

এ বছরের জানুয়ারিতে সচিবালয়ের চারপাশে তীব্র শব্দ দূষণ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) যৌথ উদ্যোগে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। 

‘নীরব এলাকা ঘোষিত সচিবালয়ের চারপাশে তীব্র শব্দ দূষণ’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সচিবালয় এলাকায় শব্দ দূষণ আগের চেয়ে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। তীব্রতার ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি দূষণ হয় পল্টন বাসস্ট্যান্ডে। এ বাসস্ট্যান্ডে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ১২৯.২ ডেসিবেল।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণশক্তি কমে গেছে সচিবালয় এলাকায় দায়িত্বরত ৯ দশমিক ৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের। ২৮ দশমিক ২৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ উচ্চস্বরে কথা না বললে শুনতে পান না। এছাড়া ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মোবাইলে কথা শুনতে অসুবিধায় ভোগেন।

জরিপ পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে হর্ন গণনার ফল অনুযায়ী ‘জিরো পয়েন্ট’ এলাকায় সবচেয়ে বেশি হর্ন গণনা করা হয়। এলাকাটিতে ১০ মিনিটে ৩৩২টি হর্ন বাজাতে দেখা যায় চালকদের। যার মধ্যে ৭০টি হাইড্রোলিক হর্ন এবং ২৬২টি সাধারণ হর্ন।

এ বিষয়ে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ১০ সদস্যের একটি গবেষক দল সচিবালয়ের আশপাশের ১২টি স্থানে শব্দের তীব্রতা নির্ণয় করে। এসময় নির্ধারিত এলাকাগুলো থেকে দিনব্যাপী ১ হাজার ৮০০ উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছিল। সে হিসেবে ১২টি স্থানে সকাল-দুপুর-বিকেলে সর্বমোট প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪০০ উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।

তিনি বলেন, ১২টি স্থানের প্রতিটিতে দিনে ১০০ ভাগ সময় নীরব এলাকার জন্য প্রযোজ্য মানমাত্রার (৫০ ডেসিবেল) চেয়ে প্রায় ২.১ গুণ বেশি মাত্রার শব্দ ছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালকদের অসচেতনতা ও প্রয়োজনের তুলনায় কম অভিযানের কারণেই সচিবালয়ের চারপাশকে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।

জানা গেছে, শুরুতে হর্ন বাজানোর কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করে পরিবেশ অধিদফতর। কিন্তু কিছুদিন পরই সবকিছু থেমে যায়। এরপর মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

তবে এ বিষয়ে জনবল কম ও পুলিশের অসহযোগিতাকে দায়ী করছেন পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতরে লোকবল কম। এজন্য নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া অভিযানের সময় পুলিশের তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। তাই চালকরা নিয়ম মানছেন না।’

তবে নীরব এলাকা কার্যকর না হওয়ার জন্য চালকদের দুষছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চালকদের মধ্যে সচেতনতা নেই। তারা হর্ন বাজিয়ে শব্দ দূষণ করে।’

তিনি বলেন, ‘বিদেশে কেউ হর্ন বাজায় না, তারপরও কিন্তু গাড়ি চলে। আমাদের চালকরা দেশের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নিয়ম ঠিকই মেনে চলে, কিন্তু এখানে সবসময় কারণে-অকারণে হর্ন বাজাচ্ছে।’

এজন্য চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘সচেতনতা সৃষ্টির জন্য চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’

সচিবালয় ছাড়াও নীরব এলাকার আওতা আরও বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি। মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সব পক্ষকে নিয়ে এটি কার্যকর করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর আমরা চেষ্টা করব সব এলাকায় যাতে নীরব এলাকা কার্যকর করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ফাইনাল পর্যায়ে আছি। সিটি করপোরেশনের সাথে আলাপ-আলোচনা চলছে। একটি কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, শব্দ দূষণ একটি সামাজিক ব্যাধি ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শব্দ দূষণ বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে।

এসএইচআর/এসএসএইচ/জেএস